Homeসাহিত্যসৃষ্টিরহস্য খুব ভাবায় : তানজীর সৌরভ

সৃষ্টিরহস্য খুব ভাবায় : তানজীর সৌরভ


তানজীর সৌরভ কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও সংগঠক। তার প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘আনকা জিরেন’, ‘ভূমিহীন দ্বীপ’ ও ‘একার জানাজা’। প্রতিষ্ঠা করেছেন আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বনাধীতি’ এবং শিল্পসাহিত্য বিষয়ক প্লাটফর্ম ‘চিন্তার ঘ্রাণ’।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?

তানজীর সৌরভ: ধরা-বাঁধা কোনো বিষয় বা অনুভূতি নিয়ে লেখার প্রবণতা কম। চিন্তাকে মুক্ত পাখির মতো উড়িয়ে দিই। যেকোনো বিষয় বা অনুভূতি মনে দাগ কাটলে, অনুরণিত হলে লিখে ফেলি। তবে, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করার খাতিরে এবং কেউ কোনো বিশেষ বিষয় দিলে তা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

তানজীর সৌরভ: এ ব্যাপারেও আমি মুক্ত। নির্দিষ্ট কোনো কিছুতে নিজেকে আটকে রাখতে পছন্দ করি না। তবে কিছু থিম বা বিষয় আমাকে চেতনে-অবচেতনে একটু বেশি তাড়া করে, অপার্থিব বিষয়াদির ব্যাপারগুলো। ভাবনার ডানা যতই প্রসারিত করি, ততই যেনো দীর্ঘ হয় সে সব পথ। সৃষ্টিরহস্য খুব ভাবায়। আমার অনেক লেখায়ও কমবেশি সেসব ছাপ পাওয়া যায়।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?

তানজীর সৌরভ: তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণা থেকে লেখার প্রবণতা বেশি। তবে চিন্তার বীজগুলো আগে থেকে প্রোথিত থাকে মনে। তাৎক্ষণিক ঘটনায় তার শব্দরূপ ঘটে মাত্র। কিন্তু ‘জায়মান পাখি মাস্টারবেশন আঁখি’ নামক একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি রিসেন্টলি। এই পাণ্ডুলিপিতে অনেক কবিতার ভাব ও শব্দ ধীরেসুস্থে সাজিয়েছি। কিছুটা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ বলা যায়। প্রকাশকের কোনো অসুবিধা না হলে এবারের মেলায় প্রকাশিত হবে আশা করি। তখন পাঠক ভালো বলতে পারবে, আসলে গতানুগতিক লেখার বাইরে নতুন কোনো রং, সুর, ধ্বনি বইটায় আছে কিনা।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?

তানজীর সৌরভ: আমার কবিতার ভাষা ও শৈলী সময়, প্রেক্ষাপট ও ঘটনা থেকে বেছে নেয়ার চেষ্টা করি। কোন ধরনের কবিতা লিখছি, তার উপর নির্ভর করে। কোন মুডে আছি, সেটাও প্রভাব ফেলে। কবিতায় নয়টা রস আছে- আদি রস, বীর রস, করুণ রস, অদ্ভুত রস, হাস্য রস, ভয়ানক রস, বীভৎস রস, রৌদ্র রস ও শান্ত রস। কোন রসের কবিতা লিখছি বা কবিতার কোন অংশে কোন রস ছড়িয়ে পড়ছে, তার উপরও কবিতার ভাষা ও শৈলী নির্ভর করে আমার ক্ষেত্রে। এছাড়া কবিতাটা কি রিয়েলিস্টিক ফর্মে নাকি অ্যাবস্ট্রাক ফর্মে লিখছি, সেসব বিষয়াদিও কাজ করে। এছাড়া কোন ইজম, বাদ, ফর্ম ইত্যাদি নিয়ে কাজ করলে, তার ভাষা ও শৈলী আলাদা হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?

তানজীর সৌরভ: এ প্রশ্ন শুনে ছোটবেলার গল্প মনে পড়ে গেল। শৈশব কৈশোরে আমার পছন্দের কবির প্রথম তালিকায় ছিল কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাদের কবিতা আবৃত্তি শেখাতো মা। স্কুলে আবৃত্তিতে প্রথম হতাম সব সময়। এবং যা মনে আসে তাই লেখার চেষ্টা করতাম। তখন কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা অনুসরণ করে লেখার চেষ্টা করতাম। কিশোর জীবন পেরিয়ে ভালো লাগতে শুরু করলো জীবনানন্দ দাশ। তখন তার ভাষা ও শৈলী লেখায় আপনা-আপনি চলে আসতো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বুঝতে পারলাম, কবিতা লিখতে হলে কবির নিজস্ব ভাষা, শৈলী ও স্টাইল প্রয়োজন। যা কবির স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে। তখন থেকে লেখায় নিজের রং, রূপ, রস, ভাব, ছন্দ, সুর, ধ্বনি ইত্যাদি বলার চেষ্টা শুরু হলো। এখনো সেই প্রয়াস চলছে। তবে আধুনিক কালের অধিকাংশ কবির কবিতা ছোটবেলা থেকেই আবৃত্তি করতাম। কারণ কবিতা প্রেমের হাতে খড়ি মায়ের কাছে শেখা আবৃত্তি ভিতর থেকে হয়েছে। আর তা কখন কীভাবে আমাকে কবিতা নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে আমি টের পাইনি। কিন্তু এখন টের পাই কবিতা যেন আমার রক্তে মিশে গেছে।

এক দেহে দুই আত্মা
যার নাম কবিতা…

বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?

তানজীর সৌরভ: এ ব্যাপারটা বলার আগে বলতে চাই— শিল্প-সাহিত্যে মৌলিক শিল্প-সাহিত্য ৩টি: পেইন্টিং, মিউজিক এবং পোয়েট্রি। শিল্প-সাহিত্যের এমন কোনো মাধ্যমে নেই যেখানে এই ৩টির ব্যবহার নেই। একটি শিল্প-সাহিত্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন এই ৩টির অনুপম সম্মিলন ঘটে। সেই হিসেবে কবিতা একটি মৌলিক শিল্প। যেখানে দারুণ ভাবে পেইন্টিং, মিউজিক ও পোয়েট্রি নিয়ে খেলা করার পরিসর রয়েছে। কবিতা কথা বলে প্রাণ, পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সকল ঘটনা ও ধরনা নিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কথাসাহিত্য হলো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আর কবিতা হলো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বিরাট ক্যানভাসকে, টিউনকে, রিদমকে সংক্ষিপ্ত আকারে বলা। না বলা কথা ও স্পেস গুলোর ভিতর অগণিত অনুরণন থাকে, কথা থাকে। যা পাঠককে ভাবায় তার মতো করে। তবে বহু কবিতা আছে—যা কিছুটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মত প্রকাশিত হয়। মহাকাব্যসহ দীর্ঘ কবিতা গুলোর দিকে তাকালে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাই। কবিতারও দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা থাকে। এখন দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে নাকি উচ্চতায় কবিতা প্রকাশ করা হবে তা কবির চিন্তা, রুচির উপর ও কবিতার ধরনের উপর নির্ভর করে। সেই হিসেবে কখনো কখনো কথাসাহিত্যের প্রভাব থাকে আমার কোনো কোনো লেখায়। আমি স্বেচ্ছায় তেমনটা করি। সেসব লেখা পড়লে পাঠকের মনে হবে, কবিতা নয় এটা যেনো গল্প। তবে আমার অধিকাংশ কবিতায় সংক্ষেপে বলার চেষ্টা থাকে বেশি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

তানজীর সৌরভ: আমার প্রথম কবিতার বই ‘আনকা জিরেন’। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে যার অনুপ্রেরণা বেশি, তিনি আমার প্রিয় মানুষ প্রিয় কবি ভাস্কর চৌধুরী। তার বিখ্যাত কবিতা ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’ কবিতার মাধ্যমে আমি কবিকে প্রথম চিনি। তবে তার সাথে সরাসরি পরিচয় ও যোগাযোগ ফেসবুকের কল্যাণে। তা প্রায় ১০ বছরের মতো হবে, কবির সাথে সরাসরি আমার পরিচয়। এবং বলতে গেলে নিয়মিত যোগাযোগ এবং শিল্পসাহিত্যের আলোচনা চলে। সেই সুবাদে উনি জানতেন আমার অনেক কবিতা জমা আছে। ২০২০ সালে উনি বললেন, তুমি সেই শৈশব কৈশোর থেকে লিখছো, এখন মনে হয় তোমার একটা বই ছাপানো উচিত। আমি বললাম, কবি বই তো প্রকাশকরা টাকা ছাড়া বের করতে চায় না। আর আমি নিজের বই নিজের টাকা দিয়ে প্রকাশ করতে চাই না। ভাস্কর দা বললেন, তোমার কবিতার একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে আমাকে পাঠিয়ো। তারপর আমি পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে তাকে জানালে ‘ভিন্নচোখে’ পাঠাতে বললেন। এরপর আমার বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য প্রিয় মানুষ প্রিয় শিল্পী—চিত্র ও ভাস্কর  আশরাফ হোসেনের কাছে বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য আবদার করলাম। উনি দারুণ পেইন্টিং আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করার জন্য দিলেন। সেই পেইন্টিং থেকে বইয়ের প্রচ্ছদ করা হলো। এবং ২০২০ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হলো।

বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?

তানজীর সৌরভ: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই ফেলে। তবে আমার ক্ষেত্রে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ গোটা চক্রটাই কাজ করে। আগের বিষয় কেমন ছিল, এখন কি ঘটছে এবং ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে সেসব বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন ভাবে চিত্রিত হয়। পৃথিবীতে ইস্যুর শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি! যদিও আমি কবিতা লিখি বিধায় সব ইস্যুতে আমার লিখতে বা বলতে হবে এমনটা আমি মনে করি না। কারণ গোটা পৃথিবী জুড়ে ওপেন সিক্রেট খেলা হলো, সবল আর দুর্বলের খেলা। সেই সবলের বিপক্ষে আর দুর্বলে পক্ষে আমার কলম চলে। কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতে কখনো বা নীরবতায়।

নিরবতা
এক শক্তিশালী কবিতা…

বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?

তানজীর সৌরভ: আমি আমার মতো করে লেখার চেষ্টা করি, এখন পাঠক কীভাবে নেয় এবং আগামীতে নেবে সেটা পাঠকের ব্যাপার।

বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

তানজীর সৌরভ: আমি বিভিন্ন বিষয়ে খুব কাছের মানুষজনকে মজা করে একটা কথা বলি— আমি পলিথিন বাদে সব খাই। পলিথিন খাই না কারণ পলিথিন হজম হয় না। সুতরাং রুচিশীল, বোধ সম্পন্ন, মাধুর্যময়, আনন্দময় সুন্দর সকল ধরনের কবিতাই আমি লিখতে চাই। কদাকার রিপ্রেজেন্ট করে পৃথিবীকে আর কলুষিত করতে চাই না।

আমি কোনো ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছি কিনা, পারব কিনা তা পাঠাক জানবে, আপনারা ভালো জানবেন, বা আমার সাহিত্য জীবন শেষ হলে হিসাবকিতাব করে লোকে বলতে পারবে। তবে কবিতার শৈলীগত বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা করি, এখনো করে যাচ্ছি।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত