সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি উপল বড়ুয়া। তার জন্ম ১৯ ডিসেম্বর, রামু, কক্সবাজার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা: সাংবাদিকতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’ (২০১৫) ও ‘উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা’ (২০১৮)। গল্পগ্রন্থ: ‘ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল’ (২০২০), উপন্যাসিকা: ‘মহাথের’ (২০২৩) এবং অনুবাদগ্রন্থ: ‘মরা বিড়ালের মাথা: জেন গল্প সংকলন’ (২০২৪)।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?
উপল বড়ুয়া: এটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। হয়ত কখনো কোনো শব্দ, কোনো দৃশ্য দেখে অদ্ভুত অনুভূতি হয়; তৎক্ষণাৎ কবিতা লিখে ফেলি এমন নয়। অনেক পরে, হয়ত বসে আছি, খাতাটা টেনে নিয়ে বা মোবাইলের নোটে লিখতে বসে সেসব দৃশ্য বা শব্দকে সাজিয়ে নিই। সেটি যে পুরোপুরি আগের অনুভূতির মতো হুবহু হয় এমন নয়, লিখতে বসলে আরেকটি অনুভূতি সামনে চলে আসে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
উপল বড়ুয়া: বর্তমানে খুব সহজ করে বন জঙ্গল বা প্রকৃতির কথা লিখে শান্তি পাই। বলতে পারেন ফুল, পাখি, লতাপাতার কথা। মানুষের কথা বলতে বলতে আমরা বন জঙ্গলের সব দখল করে নিয়েছি। নির্দিষ্ট থিমের কথা যদি বলি, নিজের অনুভূতি প্রকাশই আমার কবিতা।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?
উপল বড়ুয়া: তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় খুব কম লিখেছি। ওই যে শুরুতে বললাম, অনেক দিনের পুরোনো স্মৃতির কাছে ফিরে গিয়ে হুটহাট দুয়েকটা পঙক্তি লিখে ফেলি। তারপর সেটাকে কবিতা করে তোলার চেষ্টা থাকে। কিছু একটা দাঁড় হলে ফেসবুকে পোস্ট করি। পরে অবসরে দুয়েকবার পড়ে এডিট করার থাকলে করি।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?
উপল বড়ুয়া: একজন কবি সারাজীবন ধরে তার নিজস্ব ভাষা ও শৈলী খুঁজে বেড়ায়। অনেকে সফলও হয়। নিজে হয়েছি কিনা জানি না। আমি অত ভাবি না কবিতা নিয়ে। যেকোনো লেখার যে বিষয়টা আমাকে টানে সেটা হলো পরিমিতি আর বোধ। অযথা কোনো শব্দ বা বাক্যকে এড়ানোর চেষ্টা করি। কল্পনা ও স্মৃতির ওপরই আমি নির্ভরশীল। আর লিখতে লিখতে একটা ভাষার ওপর ক্ষাণিক হলেও দখল চলে আসে।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?
উপল বড়ুয়া: এ কথা বলতে গেলে তো বিশাল তালিকা হয়ে যাবে। আমার সমকালীন কবিদের লেখার প্রভাবই বোধহয় বেশি আছে। লেখালেখির শুরুর দিকে পত্রপত্রিকায় শূন্য দশকের কবিতা পড়তাম নিয়মিত। অস্বীকার করব না, তাদের আঙ্গিকেই মূলত লেখালেখি শুরু। এরপর ধীরে ধীরে আরো কত কী জানলাম। নব্বই, আশির কবিতা পড়েছি এরপর। তবে একদম প্রভাবের কথা বললে শামসুর রাহমানের ‘পূর্বরাগ’, আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’, স্যামুয়েল কোলরিজের ‘দ্য অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনার’, এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফক’, রবার্ট ফ্রস্টের ‘স্টপিং বাই উডস’, বিনয় মজুমদারের ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’, উৎপলকুমার বসুর, ‘যায় দিন, গ্রীষ্মের দিন, যায় দুর্ঘটনা’, অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘রিফ্রেইন’—এমন অনেক কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। তবে কবিতার চেয়ে পিংক ফ্লয়েড, বব ডিলান ও লেওনার্দ কোহেনের গান, গানের কথা আরো বেশি হয়ত প্রভাবিত করেছে আমাকে। অবচেতন মনে হয়ত এসব পাঠাভ্যাসের দ্বারস্থ হয়েছি বারংবার।
বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?
উপল বড়ুয়া: কবির চেয়ে নিজেকে লেখক পরিচয় দিতেই আমার ভালো লাগে। শুধু কবিতা লিখে শান্তি পাই না। ছোটগল্প, গদ্য, ফিকশন লিখেছি। বইও আছে। কবিতা চর্চার কারণে গদ্য লেখার ক্ষেত্রে ভাষা বিশাল এক প্রভাব রাখে। এই নয় যে, গদ্যে কাব্যিক ভাষা আমার পছন্দ। তবে একটা দৃশ্য বা ঘটনার বর্ণনার জন্য অনেক সময় আপনাকে কাব্যিকতার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এই কারণে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে আমার কবিই মনে হয়। কিছুদিন আগে হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’ পড়লাম। ওখানে একটা লাইন আছে এমন, ‘ঘুমানোর জন্য ক্লান্তির জাজিমের থেকে ভালো আর কিছুই নেই।’ এই লাইনকে কি কবিতা বলা যাবে না?
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
উপল বড়ুয়া: আমার প্রথম কবিতার বই ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তাতে প্রচুর ভুল থাকায় পরের বছর তিনটি কবিতা পাল্টে সংশোধিত সংস্করণ হয় খড়িমাড়ি প্রকাশনী থেকে। এই বই করেছিলাম ঝোঁকের বশে। প্রথম জীবনের অভিমান থেকে শুরুতে মনে হয়েছিল, এটাই শেষ। আর লিখব না। কিন্তু কবি তো আসলে মাফিয়া দলের সদস্যের মতন। না চাইলেও অনেক সময় লিখে যেতে হয়। কয়েক বছর ধরে লেখালেখির সব এক করে বই করেছিলাম। সেই উত্তেজনা পরে থাকেনি। অনেক পরে মনে হয়েছে আরেকটু সময় নিলে পারতাম। কবি তো আসলে অতৃপ্ত আত্মা।
বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?
উপল বড়ুয়া: সমকালীন যেকোনো বিষয় ব্যক্তিমাত্রকেই প্রভাবিত করে। কবিতার ক্ষেত্রেও তার প্রভাব যে পড়ে না এমন নয়। তবে তা নিয়ে সচেতনভাবে লিখতে চাই কিনা সেটিই হলো বড় বিষয়। আমিও দুয়েকটা এমন কবিতা লিখেছি। পরে মনে হয়েছে, ওসব সাময়িক উত্তেজনা। কবিতা যে বিষয়গুলো দাবি করে, সেসব অনুপস্থিত। আবার অনেকের সমকালীন বিষয় নিয়ে অসাধারণ কাজও আছে।
বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?
উপল বড়ুয়া: পাঠকদের মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এই কারণে যেকোনো লেখা ফেসবুকে দিতে ভালোবাসি। তাদের জন্যই তো সব। পাঠক অবশ্য তেমন পরামর্শ দেয় না। দিলে সেটা বিবেচনা করাই যায়।
বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
উপল বড়ুয়া: এই প্রশ্নের উত্তরও নির্দিষ্ট করে দেওয়া কঠিন। এখন বন জঙ্গলের কবিতা লিখতে ভালো লাগছে। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না। তবে কবিতার চেয়ে বেশি গদ্য লেখার ইচ্ছা আছে। যেকোনো ধরনের লেখা। কবিতাও লিখব, নিজের অনুভূতিকে তো চাপা দিয়ে রাখতে পারব না কখনো।