ব্যাপারটি মোটেই এমন নয় যে পানি জাদুঘর দেখতে আপনাকে বিদেশে যেতে হবে। জাদুঘরটি দেশের একমাত্র তো বটেই, এশিয়ার প্রথম ও বিশ্বের সপ্তম। পটুয়াখালী শহর থেকে কুয়াকাটায় যাওয়ার পথে কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারা বাজারের কাছে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয় এই পানি জাদুঘর। ১৬ দশমিক ৫ শতক জমির ওপর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ এই পানি জাদুঘর।
জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করার ফলে বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা ক্রমেই কমছে। পানি শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। পানির গুরুত্ব বোঝাতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে
বিভিন্ন পানি জাদুঘর। এসব জাদুঘর পানির ইতিহাস, ব্যবহারের কৌশল, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এবং সংরক্ষণের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। নদীমাতৃক দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিবেশগত বাস্তবতার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীতে পানি জাদুঘরের এই উদ্যোগ।
কী আছে এখানে
সড়ক থেকে নেমে জাদুঘরের দিকে গেলে দেখা মিলবে বালুতে অর্ধেক ডোবানো একটি নৌকা। এটি নদী মরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নদীতীরের জীবন-জীবিকা যে সংকটে রয়েছে, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বালুতে অর্ধেক ডোবানো নৌকার মাধ্যমে।
নৌকার সামনে দোতলা টিনশেডের একটি ঘরে পরিচালিত এই জাদুঘরের নিচতলায় রয়েছে সেমিনার কক্ষ ও টিকিট কাউন্টার। পাশে বিভিন্ন তাকে সাজানো নদীসংক্রান্ত বিভিন্ন বই ও প্রকাশনা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় গেলে চোখে পড়বে কাচের জারে থাকা বিভিন্ন নদীর পানি। এখানে বিভিন্ন জারে সাজানো রয়েছে বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ ৭০টি আন্তর্দেশীয় এবং পায়রা, রামনাবাদ, কীর্তনখোলা ও বুড়িগঙ্গার মতো স্থানীয় ৪টি নদীর পানি।
এ ছাড়া নেপালের রাকাম কর্নালী, লংলা, বাগমতী, মহাকলী, নারায়ণী ও বালান নদী এবং লন্ডনের টেমস নদী, ভারতের গঙ্গা, মিয়ানমারের ইরাবতী নদী, আরব সাগরসহ ১১টি নদীর পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে এই পানি জাদুঘরে।
শুধু যে পানি রয়েছে এই জাদুঘরে, তা কিন্তু নয়। মাটির তৈরি নানা তৈজসও রয়েছে এখানে। একসময় ঘরে ঘরে কাঁসার যে থালাবাসন ছিল, তার দেখা মিলবে। রয়েছে মাছ ধরার জাল, চাঁইসহ ঝাঁকি জাল, খুঁচনি জাল, পলো, কাঁকড়া শিকারের চাঁই ও তাঁতযন্ত্র। কৃষিজমির উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি ডোলা, মুড়ি ভাজার তলছা, ঝারড়া, মাটির তৈরি রান্নার হাঁড়িপাতিল, মাটির তৈরি মাইট, থালাবাসন, পিতলের তৈরি থালা, বাটি, বদনা, মগসহ বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে জাদুঘরটিতে। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দেশীয় খাল ও নদ-নদীর ছবি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জেলে, কুমার, তাঁতিসহ সর্বস্তরের মানুষের জীবনধারণ ও জীবিকা অর্জনের নানা শিল্পকর্ম এবং কলাপাড়া উপজেলার একটি মানচিত্র।
পানি জাদুঘরের দায়িত্বে রয়েছেন কিউরেটর
লিপি মিত্র। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানালেন, এই পানি জাদুঘরটি দেশের মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানির সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব শেখায়। শিক্ষার্থীদের জলবিজ্ঞান, পানির ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। এ ছাড়া পানির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানীয় ঐতিহ্য, জীবনধারা ও প্রযুক্তি সংরক্ষণ করে। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরতে পানি জাদুঘরটির গুরুত্ব অপরিসীম।
কখন খোলা
পানি জাদুঘর রোববার ছাড়া সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ১০ টাকা, বরিশাল বিভাগে বসবাসকারীদের জনপ্রতি ২০ এবং অন্য পর্যটকদের জনপ্রতি ১০০ টাকা প্রবেশ ফি দিতে হয়।