হামাসের হামলার জের ধরে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো ঢাকার রাজপথে সক্রিয় ছিল। বায়তুল মোকাররম, জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে অধিকাংশ ইসলামি ও বামপন্থি রাজনৈতিক দল; বিক্ষোভও হয় সারা দেশে। এবার যখন সেই গাজা এলাকাকে ফিলিস্তিন থেকে সরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য সামনে এলো; তখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে—বিশেষ করে মূলধারার ইসলামি দলসহ সাধারণ দলগুলোর মধ্যে ‘খানিক নীরবতা’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষনেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এই ‘নীরবতার’ পেছনে কয়েকটি কারণ জানা গেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ১৫ হাজার মাইল দূরের দেশটির ভূমিকার বিষয়টি সামনে রেখে দলগুলো ‘অস্তিত্ব রক্ষা’র অংশ হিসেবেই নীরব রয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সামনে থাকায় এই ‘অবাক নীরবতা’— বলেও দাবি করেন একটি দলের শীর্ষ একজন নেতা।
‘‘কোনও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়া স্টাফ প্রটোকল রিলেশনশিপ তৈরি হয়েছে দুই সরকারের মধ্যে’ এই বিষয়টি ইসলামপন্থিরা উপলব্ধি করছেন। এ কারণে নীরব রয়েছে দলগুলো। এখানে স্বার্থগত বিষয় রয়েছে’— বলে মনে করেন এই নেতা।
‘এ কারণে গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিপন্থি দলগুলো কর্মসূচি দিতে দ্বিধা বোধ করছে।’
অবশ্য হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী মনে করেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।’
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) মাওলানা রব্বানী বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহু বক্তব্য দেন। কখনও তার বক্তব্য পাগলসুলভ বলে বিবেচনা করে বিশ্ব। ফিলিস্তিন থেকে গাজাকে উচ্ছেদ করার বক্তব্যটিও শিশুসুলভ। আমরা এটাকে গুরুত্ব দেইনি, যে কারণে প্রতিবাদও করিনি। তার বক্তব্যের কোনও মূল্য নেই।’
সাধারণত নব্বই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা ছিল বেশি। ধর্মভিত্তিক দলের একাধিক নেতা মনে করেন, ওই দশকে ইসলামপন্থিরা দেশটিকে ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচনা করলেও দিনে-দিনে সেই অবস্থার উন্নতি ঘটে। কমতে থাকে প্রতিবাদ-কর্মসূচিও।
২০০১ সালের পর থেকে কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয় যুক্তরাষ্ট্র।
একটি ইসলামি দলের অন্যতম প্রধান নেতা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ওই সময় (একবিংশ শতাব্দির শুরুতে) বিএনপি-জোট সরকারের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজনেরাও যুক্তরাষ্ট্রকে কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পরামর্শ দেন। উইকিলিকসে বিশ্বব্যাপী ফাঁস হওয়া নথিতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত তারবার্তাগুলোতে এর তথ্য পাওয়া যায়।
প্রথমা প্রকাশন থেকে মশিউল আলমের অনুবাদ, সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত উইকিলিকসে বাংলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের পর ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী, জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
দূতাবাসের তৎকালীন ডেপুটি চিফ অফ মিশন জুডিথ শামাসের পাঠানো একটি তারবার্তায় বলা হয়, ২০০৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছোট ভোজসভায় পলিটিক্যাল কাউন্সেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মুফতি আমিনীর।
তারবার্তার শিরোনামে মুফতি আমিনীকে ‘উগ্রপন্থি ইসলামি সংগঠনের সভাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করলেও ওই বৈঠক ছিল উভয়পক্ষের ‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসানকল্পে। ওই বৈঠকের পর ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে থমাস জুনিয়রের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী পরামর্শ দেন, মাদ্রাসাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও পশ্চিমা দাতাদের সাহায্য বাড়াতে।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে অনেক ইসলামি নেতাদের যাতায়াত রয়েছে। যদিও ইসলামি দলগুলোর নেতারা বলছেন, হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী জীবিত থাকা অবস্থায় আমন্ত্রণ পেয়েছেন আলেমরা।
অনেক ইসলামি রাজনীতিক মনে করেন, সম্পর্ক উন্নয়নের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনও ইস্যুতে অনেক বেশি হিসাবি এখন ইসলামি দলের নেতারা। যে কারণে গাজা ইস্যুতে নীরবতা দেখা যাচ্ছে বিস্ময়করভাবে।
জানতে চাইলে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর ভাষ্য, দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোয় কেন্দ্রীয় পরীক্ষা চলছে। যে কারণে শিক্ষার্থী, শিক্ষকরা এখন ব্যস্ত। আপাতত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ কম, জানারও সুযোগ কম।
তবে তারা ‘কিছু করা দরকার’ বলে চিন্তা করছেন জানিয়ে মাওলানা ইসলামাবাদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মুসলমানদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য জালেমদের সমর্থন করতে পারি না। গাজাকে দখল করে মিটিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হলে হেফাজত মাঠে নামবে।’
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ বিবৃতি দিয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি। ট্রাম্পের বক্তব্যকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ইসরাইলিরা গাজায় যুদ্ধ বিরতির চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার কারণেই হামাস বন্দি মুক্তি স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাকে জাহান্নাম বানানোর হুমকি দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন। তার এ হুমকি সম্পূর্ণ অন্যায়, অনভিপ্রেত ও অনাকাক্ষিত।’
২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান শাহজাদা ড. সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী ‘ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসী হামলার নিন্দা জানালেও এবার অনেকটাই নীরব তার দল।
বৃহস্পতিবার বিকালে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘এখন তো মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে জোরালো প্রতিবাদ না হলে কোনও উপায় দেখছি না। যারা শান্তি-সম্প্রীতির পক্ষে তাদের একসঙ্গে হতে হবে। যুদ্ধ বিরতি হলেও গণফল হবে না। ইসরায়েল আগ্রাসন অব্যাহত রাখছে। সমস্ত বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের, ধর্মীয় নেতাদের এ বিষয়ে বসার আহ্বান জানাতে চাই।’
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর সারা দেশে জেলায় জেলায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওইদিন কোনও কোনও জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করলেও মিছিল করতে দেয়নি সাবেক সরকারের পুলিশ।
বর্তমানে দলটির কী অবস্থা এই ইস্যুতে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব আহমদ আবদুল কাইয়ূম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন-চারদিন ধরে আমাদের চরমোনাইয়ে মাহফিল চলছে। দাওয়াতি এই কার্যক্রম শেষ হলে দলীয় নেতৃত্ব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে অন্যান্য সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও গাজা ইস্যুতে চুপচাপ রয়েছেন। ২০২৩ সালে গাজা আক্রমণের সময় দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপিও কৌশলগত অবস্থান নেয়। ওই বছরের ৯ অক্টোবর সোশ্যাল হ্যান্ডেল এক্স-এ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই সময় দলটির নীতিনির্ধারকেরাও নীরবতা অবলম্বন করেন।
এর আগে ২০২১ সালে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি কভার্ডভ্যানে করে ওষুধ সামগ্রী দিয়েছিলো বিএনপি। ওই বছরের ২৬ মে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ড. ইনামুল হক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে দলটির কী অবস্থান, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির একজন প্রভাবশালী দায়িত্বশীল উল্লেখ করেন, প্রথমত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বক্তব্যটি রাজনৈতিক নাকি কৌশলগত সেটি বিবেচনায় আসতে হবে। বিএনপি বড় দল, যে কারণে কেবল বক্তব্যের ওপর প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসলে বিএনপি এ সংক্রান্ত অবস্থান ব্যক্ত করতে পারে।
এ বিষয়ে বিএনপির বিদেশ বিষয়ক কমিটির অন্তত চার জন সদস্যকে কল করা হলেও তারা কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর গাজায় হামলা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। যদিও গত ১০ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জিম্মি ইস্যুতে, ‘গাজা জাহান্নাম হয়ে যাবে’ শীর্ষক বক্তব্যের পর কোনও বিবৃতি আসেনি দলটির।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকালে সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কাছে সেটা মনে হয় না (আমেরিকাকে চটানো); বরং দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো বেশি মনোযোগী হওয়ায় এটা ঘটতে পারে। আমি বলতে পারি, গাজা ইস্যুতে মনোযোগের কমতি রয়েছে, এক ধরনের দায়িত্বহীনতার পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিষয়টিকে।’
‘চটানোর বিষয়টি কারও-কারও মনে আসতে পারে, তবে এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না’ বলে উল্লেখ করেন সাইফুল হক।