Homeদেশের গণমাধ্যমেবাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সহজ হবে কবে?

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সহজ হবে কবে?


প্রায় দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে সবচেয়ে তলানিতে। দুই দেশের সর্বোচ্চ স্তরে যোগাযোগ বা বৈঠক খুবই সীমিত। সীমান্তেও নানা জায়গায় দুইপক্ষের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উভয় দেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতি নির্ধারকরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন নিয়মিত। এর পাশাপাশি ভারতের মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা লাগামছাড়া। তেমনই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও ভারতবিরোধিতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

ভারতে এক শ্রেণির পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, আগামী বছরের (২০২৬) মাঝামাঝি নাগাদ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এর আগে তেমন উন্নতির আশা ক্ষীণ।

ঘটনাচক্রে বাংলাদেশে যখন পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা, মোটামুটি একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দুটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কতটা সংস্কার চায় তার সাপেক্ষে সর্বোচ্চ আগামী বছরের (২০২৬) জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই জুন মাসের ডেডলাইন মাস দুয়েক এগিয়েও আনা হতে পারে বলে সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৬ সালের মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ।

দিল্লির রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুকল্যাণ গোস্বামী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের নির্বাচন ভারতের শাসক দল বিজেপির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক দশক আগে প্রথমবার আসামে ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে তারা উত্তর-পূর্ব ভারতে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেয়েছে। এ কারণে যেকোনও মূল্যে তারা আসামে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবে। আর পশ্চিমবঙ্গ কার্যত বিজেপির লাস্ট ফ্রন্টিয়ার, তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নিজের রাজ্যে ক্ষমতা দখল করা বিজেপির দীর্ঘদিনের অপূর্ণ স্বপ্ন!’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ধুয়ো তুলে এবং সে দেশে ইসলামী মৌলবাদের প্রসারের কাহিনী প্রচার করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে যে ধরনের হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের হাওয়া তোলা সম্ভব হয়েছে, সেটা বিজেপিকে এই দুটি রাজ্যের নির্বাচনে ফায়দা দেবে। ফলে বিজেপি চাইবে আরও অন্তত বছরখানেক বা সোয়া বছর এই উত্তেজনা বা বিদ্বেষ জিইয়ে থাকুক। আমাদের ঘরের পাশে হিন্দুরা অত্যাচারিত, কিংবা ইসলামী জিহাদিরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিচ্ছে– এই প্রোপাগান্ডা চালানো হলে ভোটে বিজেপির লাভ হতে পারে। এ কারণে এই প্রচারণা চট করে থামবে না। ভারতের মূল ধারার বেশিরভাগ গণমাধ্যমেও আমরা এখন সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।’

এই পর্যবেক্ষকের মতে, এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশেও কোনও কোনও রাজনৈতিক শক্তির জন্যও লাভজনক। ফলে তারাও হয়তো চাইবেন না ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখনই সহজ ও স্বাভাবিক হোক!

সুকল্যাণ গোস্বামীর কথায়, ‘বাংলাদেশে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের কথাই বলি, তাদের অনেকে এখনও সরকারের অংশ। গত ছয়-সাত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারও সুশাসনের কোনও নমুনা দেখাতে পারেনি। জিনিসপত্রের আগুন দামে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এসব অপশাসন থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর সহজ রাস্তা একটাই– ভারতবিরোধিতার জিগিরটা জারি রাখা!’

তিনি মনে করেন, সীমান্তের দুই পারে দুই ধরনের রাজনৈতিক বাস্তবতাই দুদেশের সম্পর্ককে এখনই সহজ হতে দেবে না বলে ভারতের অনেকে মনে করছেন। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে ও সেই সঙ্গে আসাম-পশ্চিমবঙ্গে ভোটপর্ব মিটে গেলে হয়তো আবার বাস্তবতা অন্য রকম হবে। 

সুকল্যাণ গোস্বামীর মন্তব্যের রেশ ধরে দিল্লির সাংবাদিক বৈজয়ন্ত সিং বলেন, ‘এই থিওরিটা অনেকাংশেই সঠিক। ভারত-বাংলাদেশ কোনও পক্ষ থেকেই এ কারণে সম্পর্ক উন্নয়নের বিশেষ তাগিদ দেখা যাচ্ছে না।’

দিল্লিতে সদ্য সমাপ্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখানে চারদিন ধরে দু-পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা হলো। কিন্তু দেড়শ’ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে গেলে দুই বাহিনীর কী ভূমিকা হবে তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তই হলো না। অথচ এটা খুব জটিল বিষয় নয়। চাইলে বিএসএফ ও বিজিবি প্রধানরা একটা সমাধানের সাময়িক ফর্মুলাও বের করতে পারতেন। তাহলে কী আমরা ধরে নেবো, দুই দেশের নেতৃত্বও চাইছে সীমান্তে যে রকম কথায় কথায় গণ্ডগোল বাঁধছে, সে রকমই চলতে থাকুক?’

ভারতের রাজধানীতে যে কূটনৈতিক সাংবাদিকরা সাউথ ব্লক বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কভার করেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর জন্য ভারতের পক্ষ থেকেও বিশেষ একটা সদিচ্ছা বা আন্তরিকতা দেখা যায়নি।

সীমান্তে এ ধরনের ছোটখাটো উত্তেজনার ফুলকি কিংবা দুই দেশে পারস্পরিক ধর্মীয় মেরুকরণকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা দুদেশেরই আছে বলে তারা অনেকেই মনে করছেন।

চলতি সপ্তাহেই কলকাতার একটি নামকরা টিভি চ্যানেল আয়োজিত বিতর্কসভায় মূল থিম ছিল, ২০২৬ সালের ভোটের আগে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় মেরুকরণই কি ভবিতব্য? সেই সভায় তথাগত রায় ও রাহুল সিনহার মতো পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির দুজন সাবেক সভাপতি খোলাখুলি বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার মধ্যে অন্যায় বা অনৈতিক কিছু নেই। বিশেষ করে এখন বাংলাদেশে যা ঘটছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রয়োজন এখন আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।

তথাগত রায়ের কথায়, ‘বাংলাদেশের দেখাদেখি পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও গ্রামেও এখন গান-বাজনা করা যাবে না, মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না বলে নোটিশ পড়ছে!’ এর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।

কলকাতায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের মিডিয়া তখনই বাংলাদেশ নিয়ে হৈচৈ করে, যখন সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেয়। কিন্তু যখন অগণতান্ত্রিক ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চলে সেটার খবর দেয় না।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সব মিলিয়ে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া না মেটা পর্যন্ত ধর্মীয় মেরুকরণের এই রাজনীতিই পালে বাতাস পাবে এবং তার বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকবে ঢাকা ও দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত