অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। চাকরি ছেড়ে শুরু করেছিলেন ব্যবসা। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে হয়ে ওঠেন চামড়া খাতের একজন সফল ব্যবসায়ী, অবদান রাখেন দেশের অর্থনীতিতে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তিরাশিতে পা রাখার কথা। আজ বুধবার (১২ মার্চ) সকালে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে চাকরি ছেড়ে নিজেই ব্যবসা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। বহুজাতিক কোম্পানি পাকিস্তান টোব্যাকোর (বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো) চাকরি ছেড়ে শুরু করেন চামড়ার ব্যবসা। বড় চাকরি আর অভিজাত নিশ্চিত জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন দুর্গন্ধময় হাজারীবাগকে। দামি গাড়ি ছেড়ে চামড়ার ভাঁজে খুঁজে নেন নতুন এক অধ্যায়। তার হাত ধরে দেশে উৎপাদিত চামড়া জুতার রপ্তানি শুরু হয়।
১৯৭২ সালে মঞ্জুর ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কোম্পানি করে কমিশনের ভিত্তিতে চামড়া বিক্রির ব্যবসায় নাম লেখান এ সফল ব্যবসায়ী। ৪ বছর পর ১৯৭৬ সালে ১২ লাখ ২২ হাজার টাকায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে নিয়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী প্রতিষ্ঠা করেন এপেক্স ট্যানারি। এর ১৪ বছর পর যাত্রা শুরু হয় এপেক্স ফুটওয়্যারের।
এখন দেশের শীর্ষ জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যার। বর্তমানে এপেক্স গ্রুপে কাজ করছেন ১৭ হাজারের বেশি কর্মী। আর বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া একে একে গড়ে তুলেছেন এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড, এপেক্স ফার্মা লিমিটেড, এপেক্স ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড, ব্লু ওশান ফুটওয়্যার লিমিটেড, কোয়ান্টাম কনজ্যুমার সল্যুশন লিমিটেড, ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যার লিমিটেড।
ব্যবসার বাইরে সংগঠক হিসেবেও সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন সফল ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেন যোগাযোগ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। ২০০১ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। সংগঠক হিসেবে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) ঢাকার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা স্যার সৈয়দ নাসিম আলী (১৮৮৭-১৯৪৬) কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৩৩ সালে । পরে তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার তাকে (সৈয়দ নাসিম আলী) নাইট উপাধি দেয়। তার বড় ভাই এস এ মাসুদ যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। তিনিও পরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন। বাবার মতো তিনিও প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৭ সালে। মেজো ভাই এস এ মওদুদ বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। আর সেজো ভাই এস এ মনসুর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৬৬ সালে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী জয়পুরহাটের সংসদ সদস্য মফিজ চৌধুরীর মেয়ে নিলুফার মঞ্জুরকে বিয়ে করেন।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী স্কুল ও কলেজের পাট শেষ করে ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ১৯৬৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। সে সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন তার সহপাঠী রাশেদ খান মেনন।
নতুন উদ্যোক্তা আর ব্যবসায়ীদের কাছে বন্ধুপ্রতিম মঞ্জুর এলাহী বেঁচে থাকবেন আজীবন।
ইএআর/এসএনআর/এএসএম