Homeদেশের গণমাধ্যমেকর্মবিরতি ঘিরে নানা অঘটন, বুধবারও ট্রেন চলায় অনিশ্চয়তা

কর্মবিরতি ঘিরে নানা অঘটন, বুধবারও ট্রেন চলায় অনিশ্চয়তা


পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধার জটিলতা নিরসন না হওয়ায় কর্মবিরতিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। সোমবার রাত ১২টা পর শিডিউলে থাকা ট্রেনগুলোতে উঠেননি তারা। 

ট্রেনযাত্রার এ অনিশ্চয়তায় সারা দেশে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। ট্রেন না ছাড়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে যাত্রীরা স্টেশনে ভাঙচুরও চালান—এমন খবরও এসেছে। 

কর্মবিরতি থেকে সরে আসতে রানিং স্টাফদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে বসলেও সমাধান আসেনি। রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিক চৌধুরী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানান, দাবির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলবে না। ফলে বুধবারও ট্রেন চলায় অনিশ্চয়তা রয়েছে। 


মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি সাইদুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘক্ষণ রেল সচিব-মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি বলে বৈঠক চলাকালীনই আমি চলে এসেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। তবে আমরা আমাদের কর্মবিরতিতে অনড় আছি।’’

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন— রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। 

এর আগে, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে (ইনডিরেক্টলি) যোগাযোগ হচ্ছে। তখন ফাহিমুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘‘আমাদের আলোচনার দ্বার খোলা আছে। তারা আসলে তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো সময় ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে।’’

ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা। টিকিট রিফান্ডের বিষয়ে স্টেশন ম্যানেজার মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘‘কোন যাত্রী যদি রিফান্ড চায়, তাহলে তার টাকা ফেরত দেওয়া হবে। পরবর্তীতে যদি কোন যাত্রী যাতায়াত করতে চায়, তাহলে আবার নতুন করে ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে। এই টিকেট দিয়ে আমরা শুধু রিফান্ডের ব্যবস্থা করেছি, পরবর্তী যাত্রার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।’’ 

তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু পরবর্তী ট্রেনের টিকিটও ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে। তাই এই যাত্রীদের যদি সেই ট্রেনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে যারা টিকিট কেটেছেন, তাদের সঙ্গে এক ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে।’’

এদিকে, টিকিট রিফান্ডের পাশাপাশি যাত্রীদের সুবিধার্থে ও যাত্রীদের বিকল্প যাতায়াতের জন্য বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে ১১টি, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ১৭টি, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ৬টি, বগুড়া রেলস্টেশন থেকে ৫টি ও কুমিল্লা রেলস্টেশন থেকে ১টি নিয়ে মোট ৪০টি বাস বিভিন্ন গন্তব্য এ ছেড়েছে। 

বিআরটিসি সার্ভিস কত দিন পর্যন্ত চলবে জানতে চাইলে স্টেশন ম্যানেজার বলেন, ‘‘আশা করছি, সমস্যা থেকে খুব দ্রুতই উত্তরণ করতে পারব। সমস্যা সমাধান হলে ট্রেনের মাধ্যমেই যাত্রীর যাতায়াতের ব্যবস্থা করব।’’ 

সারা দেশে ঘটে যাওয়া আরো খবর—

দূরপাল্লার ট্রেনের অপেক্ষায় রংপুর রেলস্টেশনে ভিড় করেছিলেন অসংখ্য যাত্রী। রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে দিনব্যাপী ট্রেন চলাচল বন্ধ। স্টেশন এখন শুনশান নীরবতায় মোড়া। রাত ৯টার দিকেও বহু যাত্রী হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন, চোখে-মুখে তাদের ক্ষোভের ছাপ।

ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে রেখে এদিন সকালে চালক পালিয়ে যান। এতে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খানকে দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খান বলেন, “যাত্রীরা আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আমি উপায় না পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামলায়। টিকিটের টাকা ফেরত দিলে যাত্রীরা চলে যায়।”

কর্মবিরতির কারণে দিনাজপুরের হিলির সঙ্গে সান্তাহার ও পার্বতীপুরসহ সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।  

হিলি রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার বিশ্বনাথ কয়াল বলেন, “রেলওয়ের রানিং স্টাফরা মাইলেস ভাতা বৃদ্ধিসহ ৮ ঘণ্টা ডিউটির দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। যে কারণে সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্তাহার-পার্বতীপুর রুটসহ সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।”

ট্রেন বন্ধ থাকায় রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে ভাঙচুর চালিয়েছেন ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। পরে যাত্রীরা বিক্ষোভ করে টিকিটের টাকা ফেরত নিয়ে বিকল্প পথে রাজশাহী ছাড়ছেন। 

ক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্টেশনে টিটিদের একটি কক্ষের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন। এ সময় অন্য কক্ষগুলোর দরজা তালাবন্ধ ছিল। এ ছাড়াও যাত্রীরা স্টেশনে পেতে রাখা কিছু চেয়ার ভাঙচুর করেন। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসার পর ক্ষুব্ধ যাত্রীরা শান্ত হন। পরে টিকিটের টাকা ফেরত নিয়ে তারা স্টেশন ত্যাগ করেন।

এদিন চট্টগ্রাম স্টেশন থেকেও কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি। যেসব যাত্রী এই কর্মবিরতির খবর না জেনে স্টেশনে এসেছেন, তারা পড়েছেন দুর্ভোগে। তবে অধিকাংশ যাত্রীই আগে থেকেই কর্মবিরতির বিষয়টি অবগত থাকায় স্টেশনে আসেনি। 

সকালে চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, পাহাড়িকা এক্সপ্রেসসহ একাধিক আন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেন নির্ধারিত শিডিউল ছিল। কিন্তু ধর্মঘটের ফলে কোনো ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যায়নি। চট্টগ্রাম নতুন রেলওয়ে স্টেশনে দেখা গেছে কিছু বগি ও ইঞ্জিন স্টেশনে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের কোনো যাত্রীকে খুব একটা দেখা যায়নি। হাতেগোনা কয়েকজন যাত্রী এসেছেন, যারা এই কর্মবিরতির খবর আগে থেকে জানতেন না।

মঙ্গলবার সকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, রেলেরকর্মীদের ওভারটাইমের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন অন্যান্য দাবিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখবে। 

রেলওয়ে উপদেষ্টা বলেছেন, রেলের বরাদ্দের জন্য আপনার মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এখন আপনি যেটা করবেন সেটাই। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “রেলের কর্মচারীদের কিছু দাবি ছিল, আমরা বেশ কয়েকদিন আগেই যৌক্তিক দাবি দিয়ে দিয়েছি। তারপরও তারা কেন করেছে এটা তাদের ব্যাপার।” 

তিনি বলেন, “প্রত্যেকের একাধিক দাবি দেওয়া থাকে। তারা বলেছে এই দিতে হবে, ওভারটাইম এলাও করতে হবে। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমরা করেছি। যেভাবে দেওয়ার আমরা দিয়েছি। আমার মনে হয় মোটামুটি যেটা যৌক্তিক ছিল সেই সুবিধা আমরা দিয়েছি। এখন অন্যান্য দাবি-দাওয়াগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখবে। আমার এখানে যদি আসে যৌক্তিক কিছু থাকলে, অর্থ মন্ত্রণালয় মানা করবে না। মানবিক কারণে বা মানুষের চাকরি ব্যাপারে সমস্যা হলে, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” 

তিনি আরো বলেন, “এখন যদি বলে পেনশন গ্রাচুইটি যোগ করতে হবে। তো অন্যান্য সংস্থার তো আরো অনেক দাবি আছে।” 

এখন যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে রেল বন্ধ করে দিয়েছে, এটির কী হবে? সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “এটা রেলওয়ে উপদেষ্টা বলবেন।” 

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘‘যাত্রীদের জিম্মি করে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি অযৌক্তিক। রানিং স্টাফদের দাবি অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে।’’

রানিং স্টাফদের উদ্দেশ করে উপদেষ্টা বলেন, “আলোচনার দ্বার খোলা আছে। তারা চাইলে আমরা আলোচনায় বসব।”

উপদেষ্টা বলেন, “যাত্রীদের জিম্মি করে কর্মবিরতি অযৌক্তিক। আন্দোলন না করে আলোচনার আহ্বান থাকবে। সরকারকে বাধ্য করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করলে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন রানিং স্টাফরা। এই রানিং স্টাফরা হলেন গার্ড, ট্রেনের চালক (লোকোমাস্টার), সহকারী চালক ও টিকিট পরিদর্শক (টিটিই)। এ ধরনের কর্মী রয়েছেন প্রায় দুই হাজার। তারা সাধারণত দীর্ঘ সময় ট্রেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫–১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেজন্য তাদের আগে দেওয়া হত বিশেষ আর্থিক সুবিধা, যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ।

প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। ৮ ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ। তাদের বেতনও সেভাবেই দেওয়া হত।

এ ছাড়া, মূল বেতনের হিসাবে অবসরকালীন ভাতা যা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরো ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেওয়া হত।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করছে।

 





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত