জুলাই আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি অন্তঃস্বত্ত্বাও হয়েছেন। এ ঘটনা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, উমামা ফাতেমা, নুসরাত তাবাসসুমসহ অন্যদের বিষয়টি জানালেও কাউকে পাশে না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন তিনি।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের সম্মুখ ভূমিকা’ নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন দাবি করেন তিনি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (পুনাব) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে ঘটনার বিবরণ দিয়ে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া গোল চত্বর থেকে ছাত্রলীগের ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল আমাকে তুলে নিয়ে যায়। তারা আমাকে কলেজ রোডের পেছনে, আজমেরী ওসমানের (শামীম ওসমানের ভাতিজা) বাসার পাশের একটি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাকে অনেক গালিগালাজ করে। এক পর্যায়ের অফিস থেকে সবাইকে বের করে দেওয়া হয়। তবে দুজন সেখানে ছিল। পরে তারা আমাকে ধর্ষণ করে।’ যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেরাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন এই ছাত্রী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গে কথোপকথনের তথ্য উল্লেখ করে ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগ, ‘‘এ ঘটনা এখন পর্যন্ত কোনও মিডিয়ায় আসেনি। কারণ আমি নিজেই আসতে দেইনি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা (ধর্ষক) বাইরে ঘুরছে। তাদের কোনও শাস্তি হয়নি। সারজিস ভাই থেকে শুরু করে উমামা ফাতেমা, নুসরাত তাবাসসুম সবাই জানে। উমামা ফাতেমাকে যখন আমি জানাই তিনি বলেন— ‘ওহ আচ্ছা! তোমার সঙ্গে অনেক খারাপ হয়েছে। আচ্ছা দেখবো বিষয়টি।’ এখানেই তিনি ক্লোজ করে দিয়েছেন টপিকটি।’’
অভিযোগের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উনি বিষয়টা জানানোর পরপরই আমি তাকে মামলা করতে বলি। মামলা করলে আমাদের সাহায্য করতে সুবিধা হবে অথবা মামলা না নিতে চাইলেও আমরা সাহায্য করতে পারবো। প্রথমে মামলা করতে না চাইলেও পরে তিনি মামলাটি নারায়ণগঞ্জে নিতে বলেন। তখন আমি নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক মুনা আপুকে বিষয়টি জানাই এবং সাহায্য করতে বলি। তখন মেয়েটি আমাকে বলে যে, মেহরাব সিফাত ও মুনা আপু (নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বে থাকা সমন্বয়ক) উনারা বিষয়টি জানে, কিন্তু উনারা কিছু করছেন না। পরে সে আমাকে জানায় যে সে কারও উপর ভরসা করতে পারছে না। সে আমার সঙ্গে কাজ করতে চায়। আমি যে তাকে একটা দায়িত্ব দেই।‘
এমন শুনে ‘খুব অদ্ভুত লেগেছে’ উল্লেখ করে উমামা ফাতেমা বলেন, ‘সে সবাইকে রিচ করেছে, হেল্প চেয়েছে। যখন সবাই হেল্প করতে গিয়েছে, সে প্রত্যেককে বলেছে— সে হেল্প চায় না। তাকে অনেকেই বোঝানো হয়েছে, মামলা করতে বলা হয়েছে, কিন্তু সে নাকি হেল্প চায় না। সে সবাইকে গণহারে মেসেজ দিয়ে হেল্প না নিয়ে কীভাবে এটাকে ফ্রেম করা যায়, সেই পথে হাঁটছে।’
শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে ধর্ষণের শিকার ওই নারী শিক্ষার্থী তার বক্তব্যে বলেন, ‘নুসরাত তাবাসসুম আপা (সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম) আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দিতে বললে, আমি তাকে মেসেজ দেই। তিনি সিন করে রিপ্লাই দেননি। সারজিস ভাই (সমন্বয়ক সারজিস আলম) শুরু থেকে দায়িত্ব নেন, বিষয়টি দেখার। কিন্তু তাকে আমি প্রতিনিয়ত হোয়াটসঅ্যাপে মনে করিয়ে দিলেও তিনি ১ মাস পর রিপ্লাই দিয়ে বলেন— আমি কাজে ব্যস্ত আছি, তোমার ব্যাপারটি পরে দেখবো। এখানেই বিষয়টি ক্লোজ করে দেওয়া হয়। নভেম্বরের ১০ তারিখে আমি কনসিভ করি। এটাও জানানো হয়েছে।’
এই বক্তব্যের ভিডিও এরইমধ্যে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আহনাফ তাহমিদ নামের একজন এই ভিডিও শেয়ার দিয়ে সমন্বয়কদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার সেই পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম আরেকটি পাল্টা পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘জনাব আহনাফ তাহমিদ, আপনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, (শিক্ষার্থীর নাম)-কে একবার আমার সামনে এনে অভিযোগ করতে বলেন, যে তাকে সাহায্য করতে চাওয়া হয়নি। তাকে সবরকম সাহায্য দিতে চাওয়া হয়েছিল। তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তার সুচিকিৎসা, নারায়ণগঞ্জের ঘটনাস্থলে তদন্ত, মামলা সব কিছুর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে চেয়েছিল অন্য কিছু। কিন্তু তার অনুমতি ব্যতিরেকে আমি সেটা প্রকাশ করতে পারছি না। তাকে (অভিযোগকারী শিক্ষার্থী) বলুন নাম নিয়ে অভিযোগ করতে। অন্যথায় তার স্টেটমেন্ট এবং আপনার বিরুদ্ধে না জেনে অভিযোগ করার নিন্দা একসঙ্গে উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দেওয়া হবে।’
পাল্টা অভিযোগ সমন্বয়ক সামিয়া মাসুদ মম’র
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা ওই ছাত্রী আইনি সহায়তা নিতে গড়িমসি করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সামিয়া মাসুদ মম। তিনি এ ঘটনার শুরু থেকেই ওই নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার সঙ্গে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ও একটি অডিও রেকর্ড পোস্ট করে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।
তিনি জানান, ওই নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার পরিচয় হয় আগস্টের পরে, নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পর। এরপর থেকে তাদের মধ্যে ভালো একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই এক পর্যায়ে তিনি ধর্ষণের ওই ঘটনা জানান। পরে তাকে উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে ওই ছাত্রী আর এগোয়নি বলেও জানান মম। এমনকি ধর্ষকদের নাম কিংবা চেহারাও তার মনে নেই বলেও জানিয়েছে সে।
তিনি লেখেন, ‘একদিন হঠাৎ মাহি আমার কাছে এসে বলে, ঢাবিতে অনেক আসন ফাঁকা আছে। তার জন্য যেন একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিই। আমি তখন ওকে বোঝাই যে, এটা পুরোপুরিভাবে অবৈধ এবং এটা করাও সম্ভব না।’
পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওই ছাত্রী ১০ আগস্ট ঢাকায় আরও একবার ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলেও জানিয়েছিল। ওই ছাত্রীর ভাষ্য তুলে ধরে মম বলেন, ‘সেদিন সে (অভিযোগকারী ছাত্রী) ঢাকার বাইরে এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে গিয়েছিল একা একা। ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়। তখন সে উবারে বাইক কল করে এবং বাইক দিয়ে ফেরার পথে বাইক ড্রাইভার তাকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, যাত্রাবাড়ীর আশপাশে একটা এলাকায় নিয়ে ধর্ষণ করে। তখন আমি তার কাছে কল লিস্ট ঘেটে বাইক ড্রাইভারের নম্বরটা দিতে বলি। যেহেতু তার ভাষ্যমতে সে উবারে বাইক কল করেছে, রাইডারের নম্বর বা ট্র্যাকিং হিস্টোরি থাকার কথা। তৎক্ষনাৎ আমাকে জানায়, সে ভুল বলেছে, উবারে বাইক কল করেনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বাইকারের বাইকে উঠেছে। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করি সে, বাইকারকে চিনতে পারবে কি না। সে বললো না, চিনতে পারবে না, কারণ ধর্ষণ করার সময় বাইকারের মাথায় হেলমেট পরা ছিল।’
তাদের সঙ্গে কথোপকথনের এমন বেশ কয়েকটি অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে মম বলেন, যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, প্রত্যেকে তাকে আইনি পদক্ষেপসহ মেডিক্যাল রিলেটেড ব্যাপারেও হেল্প করতে চায়। কিন্তু সে বিভিন্নভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে গড়িমসি করতে থাকে। কোনও ডাক্তারের কাছেও যায় না, কোনো প্রেসক্রিপশনও দেখাতে পারে না। মামলা করার জন্য উদ্যোগ নিলেও সে এগোতে চায় না, গড়িমসি করে।
ওই ছাত্রীকে উদ্দেশ করে মম লিখেছেন, ‘তুমি আমাকেসহ অনেককেই বলেছো যে, আমি তোমাকে পুরোটা সময় বোনের মতো সাপোর্ট দিয়েছি। তোমাকে আমি আহ্বান করছি, সামনে আসো, মুখোমুখি হও এবং বিনা কারণে মিথ্যাচার না করে সত্যটা সামনাসামনি পরিষ্কার করো সৎ সাহস থাকলে। যেভাবে আজ ওপেনলি একপাক্ষিক বক্তব্য দিয়ে সবার সামনে মিথ্যাচার করেছো, সেভাবে সামনাসামনি হয়ে বলো যে, তোমাকে বৈষম্যবিরোধীর সবাই সাপোর্ট দিতে চেয়েছে কিনা? তুমি গড়িমসি করেছো কিনা?’