Homeজাতীয়স্বাধীন বিচারকাজে প্রধান বাধা ১১৬ অনুচ্ছেদ

স্বাধীন বিচারকাজে প্রধান বাধা ১১৬ অনুচ্ছেদ


২০২০ সালের ৩ মার্চ; দুপুর নাগাদ এক দুর্নীতির মামলায় পিরোজপুরের সাবেক সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীর জামিন আবেদন নাকচ করে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দিলেন জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নান। বিকেল না পেরোতেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে বদলির নির্দেশ পেলেন ওই বিচারক। সেই বিকেলেই এক যুগ্ম জেলা জজকে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব দিয়ে আসামিদের জামিনের ব্যবস্থা করা হলো।

সংবিধানে বিচারকদের কাজের স্বাধীনতা থাকার অঙ্গীকার থাকলেও বাস্তবে দেশের বিচার বিভাগকে কমবেশি কী চর্চার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দশকের পর দশক ধরে, পিরোজপুরের ঘটনা তার একটি উদাহরণমাত্র। এ ধরনের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার সুপারিশ করেছে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। গত ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিক সুপারিশ জমা দিয়েছে কমিশন। কমিশনের মতে, মন্ত্রণালয়ের হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বজায় থাকা। কাগজে-কলমে বিচারকদের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকলেও এর সুবাদে অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।

প্রসঙ্গত, কাজের সুবিধার্থে সময়সীমা বাড়ানোর পর কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে যাচ্ছে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁরা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত রাখতে বলেছেন। তবে কাউকে যদি গুরুদণ্ড দিতে বা অপসারণ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করার বিধানের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তানিম হোসেইন শাওন বলেন, ‘পৃথক সচিবালয় ও সুপ্রিম কোর্টের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে বলে আমি মনে করি।’

আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা এবং ১১৬ক অনুচ্ছেদে বিচারকদের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের দ্বারা নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে বিচারকাজ চালানোর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা’।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার বিষয়ে মূল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি তথা নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকবে। তবে ওই ক্ষমতার প্রয়োগ তিনি করবেন সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একধরনের বাধা। এই অনুচ্ছেদ নিয়ে রুল জারি করা হয়েছে। এটি বাতিল হলে বিচার বিভাগের জন্য ভালো হবে।’

আলোচিত মাসদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে রায়ে বলা হয়, বিচার বিভাগে নিযুক্ত কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগের অংশ নন। তাঁরা একটি সাংবিধানিক সার্ভিসের সদস্য এবং তাঁদের জন্য স্বতন্ত্র চাকরিবিধি প্রণয়ন করতে হবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের মতে, বিধিমালা প্রণীত হলেও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিচার বিভাগে বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার বিধান নানাভাবে অবহেলিত হয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে জেলা পর্যায়ের আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে—

(ক) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের ‘পরামর্শ প্রদানকারী’ যে ভূমিকার উল্লেখ আছে, তা পরিবর্তন করতে হবে। বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর এবং বেতন-ভাতা ও আর্থিক সুবিধাদি নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের হাতেই ন্যস্ত করতে হবে।

(খ) সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত মৌলিক বিধানের প্রতিফলন ঘটাতে মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে প্রণীত চাকরিবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।

(গ) জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের কার্যপরিধি বিস্তৃত করে অ্যাটর্নি সার্ভিসে প্রবেশ পদে নিয়োগকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ জন্য কমিশনের নাম পরিবর্তন করে ‘লিগ্যাল অ্যান্ড জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন’ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এর জন্য সংবিধানে আনুষঙ্গিক বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে অথবা বিদ্যমান সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।

(ঘ) সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার যথাযথ ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিচার বিভাগের প্রশাসনিক, আর্থিক এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সংবিধানে সংসদ সচিবালয়বিষয়ক ৭৯ অনুচ্ছেদের অনুরূপ বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(ঙ) বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং বাজেট নিশ্চিত করতে হবে, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের হাতে।

(চ) সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয়ের তালিকায় বিচার বিভাগে কর্মরত জনবলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ইতিমধ্যে ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন কয়েকজন আইনজীবী। সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর গত বছরের ২৭ অক্টোবর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ-সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, তা-ও জানতে চান হাইকোর্ট। ওই রুলের শুনানি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ওই অনুচ্ছেদের বদৌলতে বিচারকদের মন্ত্রণালয় থেকে অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে বিচারকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। তাই এই অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত