১৭ এপ্রিল কী ঘটেছিল এই দেশটিতে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল?
১৭ এপ্রিল তারিখটায় পৌঁছুতে হলে মেলে ধরতে হয় ইতিহাসের ডানা। এই দিনটিতে বৈদ্যনাথতলা হয়ে ওঠে মুজিবনগর। কেন মুজিবনগর? মুজিব তো তখন নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরেছে ইয়াহিয়া। বিচারের নাম করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার তোড়জোড় চলছে তখন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেওয়ার জন্য যে জায়গাটি বেছে নেওয়া হলো, তার নাম তো আর কিছুই হতে পারে না। তাই বৈদ্যনাথতলা রাতারাতি বদলে গিয়ে নাম ধারন করল মুজিবনগর। মুজিব তখন প্রতিটি মানুষের প্রাণের শক্তি, মুজিব তখন নিজেই একটি দেশের প্রতিচ্ছবি।
সেই ইতিহাস কি ভুলে যাবে মানুষ?
কবিরা যদিও বলে থাকেন, ‘লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’ কিন্তু সবাই কি ভোলে? সবকিছু কি ভোলা যায়? ভুলিয়ে দিতে চাইলেও মনের কোনো সুক্ষ্ণ কোনে সত্য কি জেগে থাকে না? নাকি সকলই গরল ভেল?
সেই প্রচণ্ড পৈশাচিকতার পর প্রতিদিন চলছিল বাঙালি নিধন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১৭ এপ্রিল সেই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় এই সরকার।
২
ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার হানাদার বাহিনীকে, ২৫ মার্চ রাতে। সেই একাত্তরের কথাই তো বলছি। মুখে বলছিল, আলোচনা চলছে। কেন এ রকম মিথ্যে বলছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? অপারেশন সার্চলাইটের ঝাণ্ডা-বরদাররা ছিল ইয়াহিয়ার পাশেই। তারা অবিরত ইয়াহিয়ার কানে কানে বলে চলেছিল, ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে বুঝতে না দেন তার মনের মধ্যে কী আছে। বলে চলেছিল, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পরিষদ বসার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার ভান করাকে যেন প্রাধান্য দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা-অন্তে আছে সমাধান—এ রকম কথাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মঞ্চে।
কিন্তু তখন তো প্লেন ভর্তি সৈন্য আসছে ঢাকায়।
কেন আসছে?
তখন তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
কেন যাচ্ছে?
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না বাংলায়।
কেন দেওয়া হচ্ছে না?
অন্ধকার যে ঘণীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই দেশের ভাগ্যে, সেটা কি আঁচ করা যাচ্ছিল তখন?
৩
১৭ এপ্রিলের মুজিবনগরে এসে দাঁড়াতে হলে আমাদের তো আগের কিছু কথা বলে নিতেই হবে। নইলে কীভাবে এই দিনটি এল, কীভাবে বাংলার মানুষ জানল, মানচিত্রে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে, বাংলাদেশ তার নাম?
এই দেশের রাষ্ট্রপতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে। তারপরও তাঁকেই কেন প্রেসিডেন্ট করা হলো নব গঠিত এই দেশের?
এ প্রশ্ন কি জেগে ওঠে না আজকের তরুণের মনে?
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে টিটকারি মেরে বলে থাকে, তিনি তো পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে!
ডাহা মিথ্যে কথা! মেরুদণ্ড সোজা রেখে এই সকল অপপ্রচারকারীকে সিকান্দর আবু জাফরের ভাষায় বলতে হয়, ‘তুমি বাংলা ছাড়ো!’ কেন বলতে হয়? বলতে হয় এই কারণে যে, বাংলার ইতিহাস না জানলে এই ‘পালিয়ে যাওয়া’ তত্ত্বই গিলে খেতে হবে।
যে মানুষটিকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়, সেই মানুষটি কি জানতেন না, ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী তাঁকে হত্যা করতে পারে? জানতেন না, স্বল্পকাল আগে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসির দড়িতে লটকে দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছিল? প্রবল গণ আন্দোলন, তথা গণ অভ্যূত্থানই জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত পৃথিবীতে?
শেখ মুজিব নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
আর তাঁর নামেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ।
৪
মুজিবনগর সরকার গঠনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। তবে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে গেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধের শেষ সময়েই কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও যুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে ভারতের দিক থেকে মুজিবনগর সরকার কোনো বাধা পায়নি। আর এই স্বীকৃতি দেয়া-না দেয়ার বিষয়টি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাষ্ট্রকে মদদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু পিছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা বাঙালিকে দল-মত-নির্বিশেষে একাত্ম করেছে। পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আসন্ন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার রেশ অপারেশন সার্চলাইট পর্যন্তই চলে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণের পর আর কারো কোনো সন্দেহ থাকেনি যে, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জন্ম একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানিরাই বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেই সময়টিকে তৈরি করে দিলো।
সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল অবধারিত। কিন্তু ইয়াহিয়া-ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জান্তার দল ভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। কৌশল না বলে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র বললেই তা লক্ষভেদী হবে। ইয়াহিয়া বিক্ষোভের জবাব দিতে চেয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায়। কিন্তু ততদিনে এই আন্দোলন হয়ে উঠেছে স্বতস্ফূর্ত। মোটামুটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলনে শরিক মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মেনে চলছিলেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী যেভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে সেই রক্ষক্ষয়ী নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপরীতপক্ষ ছিল, তারাও এক হয়ে বাংলাদেশীদের একাট্টা করে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেদের জয়ী মনে করলেও মূলত তাদের এই জয় ছিল সাময়িক আর এই সময়ের ইতিহাসের ভ্রুণে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, তাতে লেখা ছিল, ‘শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্র রচনা করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান না করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখে এবং আলাপ আলোচনা চলাকালে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরও ঘোষণা করেন, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা বা প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস ১০ এপ্রিল হয়েছে, তাই আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের তারিখ ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয় দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন, তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু সেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরন করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তো কিছুদিনের জন্য হরেও পিছিয়ে যেত।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত।’
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যরা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
১৪ এপ্রিল জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু নির্দেশাবলি জারি করেন। এবং এদিন অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের দায়িত্ব। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব পান মেজর শফিউল্লাহ। আর মেজর এম এ ওসমান পান দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব।
৫
এবার ১৭ এপ্রিলের ঘটনা শোনা যাক কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে।
প্রথমেই পাবনার সাবেক ডিসি ও পরবর্তীকালে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সচিব মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের কথা আলোচনায় আনতে পারি।
কেমন ছিল সেদিন বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর?
মোহাম্মদ নূরুল কাদেরের ভাষায়, ‘নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরি হলো, আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা কিংবা ব্যনার কোনোটাই লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন, তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো।’
তিনি লিখছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হাফিজ ও আমার ওপর অর্পিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে সব পথ দিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে আমরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করি। তখন বেলা এগারোটা। আমগাছের ফাঁক দিয়ে এপ্রিলের সূর্যের নিশানা। আমবাগানের ভেতর কয়েক হাজার দর্শক। ক্ষণে ক্ষণে গগনবিদারী শ্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ উত্তেজনা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। কারণ উপস্থিত সবাই এমন এক দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে, যা কারো পক্ষেই ইতিপূর্বে দেখা সম্ভব হয়নি। একটি জাতির জীবনে এ ধরনের অনুষ্ঠান অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এই বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বৈদ্যনাথতলা হয়ে গেল মুজিবনগর। (একাত্তর আমার, মোহাম্মদ নূরুল কাদের, পৃষ্ঠা ৪৭)।
মোহাম্মদ নূরুল কাদের তার স্মৃতিচারণে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রমের কথা বলেছেন। হাফিজু উদ্দিন আহমদ তাঁর ‘সৈনিকের জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর নামের বইয়ে লিখেছেন, ’ ১০ এপ্রিল ভারতের সহায়তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলা। তিনদিক থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড বেষ্টিত। এখানে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আমবাগান। সেখানে দুটি কাঠের চৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাজসজ্জা বা জৌলুস নেই। হাজার হাজার জনতা সীমান্তের উভয় পার থেকে এসে আমবাগানে সমবেত হয়েছে। সবার চোখে মুখে ঔৎসুক্য।
‘আমরা বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় পৌঁছলাম। নেতারা যথাসময়েই সেখানে এসে পৌঁছুলেন। রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার দায়িত্ব ইপিআর সেনাদলের। কিন্তু আমাদের পৌঁছুতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আটজন আনসারের সমন্বয়ে একটি দল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন।
এখানেই দেখা হলো প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানির সঙ্গে। তিনি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে আর্মি সার্ভিস কোরে কমিশনপ্রাপ্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর চালচলন বা ম্যানারিজমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য দৃশ্যমান। হালকা-পাতলা গড়ন, প্রখর ব্যক্তিতের অধিকারী। বিশাল গোঁফ তার মুখমণ্ডলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সহজেই সমীহ আদায় করে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হন এবং প্রথম ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার রূপে দায়িত্ব পালন করেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলেন প্রধান সেনাপতি ওসমানি। পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালেন, ‘ওহ মাই বয়! জলি গুড শো।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’ আমি বললাম।
‘আমি পরদিন বেনাপোল যাব সিনিয়র টাইগারদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।’ ওসমানি বললেন।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার। আমরা অপেক্ষায় থাকব।’ আমি বললাম।
উপস্থিত চারজন সেনা কর্মকর্তা মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন এ টি সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রধান সেনাপতি। ছোটমঞ্চের পাশে ছয়টি ফোল্ডিং চেয়ারে উপবিষ্ট হলাম ভারতের লে. কর্ণেল মেঘ সিংসহ আমরা ছয় অফিসার।
একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ফলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি রুপে শপথ গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মন্ত্রী রুপে শপথ নেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। কর্নেল ওসমানিকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক মুভি ক্যামেরা নিয়ে এই অনুষ্ঠান কাভার করেন। শপথগ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজি ভাষায় চমৎকার একটি বক্তব্য দেন। বাঙালিদের বঞ্চনার ইতিহাস, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আবেদন জানান। হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সে বক্তব্য শোনেন। আম্রকাননের অনুষ্ঠান, পরিবেশ, পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। কয়েক কিলোমিটার দূরেই পলাশীর আম্রকানন। ১৭৫৭ সালে সেখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ আরেক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য আবার উদিত হলো।
মুজিবনগর সরকারের কেবিনেট সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম নামেই তিনি পরিচিত) মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলছেন, ‘আমাদের সরকার মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যেটি আমরা বলতাম, তার প্রধান দপ্তর বা হেড কোয়ার্টার ছিল মুজিবনগর।
আপনারা সবাই জানেন যে, মুজিবনগর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুর জেলায় আমবাগানে। পলাশীর বিখ্যাত আমবাগানের কাছেই সেই জায়গাটিতেই মুজিবনগর। মুজিব নগরেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। আমাদের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামেই মুজিবনগর করা হয়। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অন্য মন্ত্রীরা ছিলেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আরও অনেক বড় নেতা ছিলেন।
যুদ্ধকালীন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদবধ বা পরবর্তীকালেও যে সমস্ত প্রবাসী সরকার দেখেন, তারা কিন্তু নিরাপত্তার কারণে, রাজনৈতিক কারণে ঠিক একটি জায়গায় কোনো সময়েই থাকেননি। মুজিবনগর হেডকোয়ার্টার ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ছিল। কিন্তু আমাদের মূল দপ্তর ছিল কোলকাতায়, থিয়েটার রোডে। সেখানেই আমাদের যৌথ বাহিনী, মিত্র বাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল। (বাংলাদেশ ১৯৭১, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১১)।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি সংযোজন হতে পারে। দীর্ঘ সে স্মৃতিচারণের নির্দিষ্ট একটি অংশই এখানে দেওয়া হলো:
‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। তিনি আত্মগোপনের কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’
এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাজউদ্দীন আহমদসহ তিনি সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছুলেন। তারপর বলছেন, ‘সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি ব্রিটিশ যুগের তৈরি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। অফিসারটি জানান, আমাদের তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিকপ্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌছলেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তবে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।
মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফের প্রধান রুস্তমজি। রুস্তমজি একসময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’
‘এদিকে আমার কাপড়-চোপড়ের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। গাড়িতেই শুরু হয় আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কোথায়? মজুমদারের প্রথম প্রশ্নও ছিল এটাই। এর পরে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সকলেরই প্রথম প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। দলীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে আমরা একই উত্তর দিয়েছি। আমরা যা বলতে চেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাচ্ছি। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। সময় হলে বা প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি উপযুক্ত স্থানে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘একটি সুন্দর বাড়িতে (আসাম হাউস) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। স্নান করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তার ইস্ত্রি করা।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
“৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোনো সহযোগী ছিল না। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। “হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” (শেখ মুজিব কেমন আছেন?) মিসেস গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।’ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।”
“তাজউদ্দীন ভাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহের। মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।”
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ
‘পরদিন তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি।’
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাঁদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলোচনা হয়। …দিল্লিতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয়। বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘোষণা প্রচারিত হয়-এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। এর পর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন।’
‘…মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’
“স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটা কপি তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এর পর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’।’
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন
“এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর ছিল। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই।”
‘সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানো হবে।’
‘রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্র হব।
গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইক্লোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সাথে অনেক কথা হলো। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তৌফিক ইলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন।’
আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ
‘কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি অস্বীকার করে তা হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতরে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি।’
‘আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়।’
(মুজিবনগর, কাঠামো ও কার্যকারণ, সম্পাদনা আফসান চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১১৪-১২৫)
এই বর্ণনার পর নিশ্চয় যে কোনো বিবেচক পাঠক বুঝতে পারবেন, ১৭ এপ্রিল কীভাবে আমাদের হয়েছিল।