ইফতার তৈরির জন্য সবচেয়ে দরকারি পণ্য হচ্ছে সয়াবিন তেল। ছোলা ভাজা থেকে শুরু করে আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু, রোল, হালিম, তরকারি রান্নাসহ সবকিছুতেই প্রয়োজন সয়াবিন তেল। অথচ সেই তেলই নেই বাজারে। গত কয়েক মাস ধরে বাজারে সরবরাহ কম থাকলেও রোজার শুরুতে সয়াবিন তেলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সরেজমিন সোমবার (৩ মার্চ) রাজধানীর নয়াপল্টন, নয়াবাজার, লক্ষ্মী বাজার, নাজিরা বাজার, রায় সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুদি দোকানগুলোতে সয়াবিন তেলের অস্তিত্ব নেই। হাতেগোনা যে কয়েকটি দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ক্রেতারা দোকানে দোকানে ঘুরেও এক লিটার, দুই লিটার সয়াবিন তেলের বোতল খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার অনেক দোকানে দৃশ্যমান স্থানে ভোজ্যতেল প্রদর্শন করা হচ্ছে না। তেল নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্রেতাকে। ক্রেতাদের অভিযোগ, অনেক জায়গায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি দরে বিক্রির আশায় ভোজ্যতেলের বোতল মজুত করে রেখেছে, যা ভোক্তা অধিকারের তল্লাশিতে পাওয়া যাচ্ছে।
পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আবুল মকসুদ এসেছেন নয়াবাজারে বাসার প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য কিনতে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, বাসায় ইফতারি বানানোর জন্য মোটামুটি সব কিনেছি। এখন যেটা আসল দরকারি সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। নয়া বাজারের অন্তত ১০টি মুদি দোকানে গিয়েছি তেল কিনতে, কিন্তু কোথাও সয়াবিন তেল নেই।
আবুল মকসুদ আরও বলেন, রমজান এলে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সরকার পতনের পর ভেবেছিলাম এবার দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে কাঁচাবাজারের বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ বেগুন, শসা, লেবুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ।
লক্ষ্মীবাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা সরওয়ার হোসেন নামের একজন ক্রেতা বলেন, গত কয়েক মাস ধরে চলা ভোজ্যতেলের সংকট একটুও কাটেনি বরং তীব্র হচ্ছে। চালের দামও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। মাছ মাংসের দামও বেড়েই চলেছে। কোনো কিছুতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। সরকার কোনোভাবেই মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর এই সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী।
এই ক্রেতা আরও বলেন, বড় বড় গ্রুপগুলো তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে। তার মধ্যে অন্যতম মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ এবং বসুন্ধরা। সরকার সবকিছু জেনে-বুঝেও কিছু করতে পারছে না, তাদের হাতে জিম্মি।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সয়াবিন তেলের চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারি বিক্রেতারা তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে মজুত করে রেখেছেন। তাই ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
নাজিরাবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে তেল চেয়েও তেল পাচ্ছি না। রবিবার (২ মার্চ) অনেক অনুরোধ করে এক কার্টন তেল পেয়েছি। দোকানে আনার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। পাইকারি বিক্রেতারা যদি তেল না দেয়, তাহলে তো আমরা বিক্রি করতে পারি না। অনেকে অভিযোগ করেন আমরা নাকি তেল মজুত করে রাখি। কিন্তু আমাদের তো স্বল্প পুঁজি। এই পুঁজিতে বাড়তি টাকা দিয়ে তেল মজুত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
শাহজাহান সিরাজ নামের একজন পাইকারি সয়াবিন তেল বিক্রেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তেল নিতে চাইলে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। তারা তেলের সঙ্গে তাদের অন্যান্য প্রোডাক্ট নিতে বলে। সেসব নেওয়া শর্তেও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বিক্রেতারা যদি কোম্পানি থেকে পর্যাপ্ত তেল না পায়, তাহলে তো খুচরা পর্যায়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে ভোক্তা অধিকার আমাদের ওপর চড়াও হয়।
এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ে থেকে প্রত্যেকটা কোম্পানিকে নোটিশ দেওয়া প্রয়োজন। তাদের তদন্ত করে বের করা উচিত সমস্যা কোন জায়গায়। কার নির্দেশনায় কীসের জন্য কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে কোম্পানিগুলো প্রয়োজন মতো তেল সরবরাহ করছে না, তা তদন্ত করে বের করা উচিত। নয়তো এই দুর্ভোগ কমবে না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার গণমাধ্যমকে আক্ষেপ করে বলেন, ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন—২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। কোনও সংকট থাকবে না। কিন্তু তারা কথা দিয়েও সেই কথা রাখেননি। এখন আমরা একটি কমিটি করে বের করার চেষ্টা করছি— সংকটটা কারা কীভাবে তৈরি করেছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। এর বাইরে রোজার অন্যান্য আমদানি পণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ স্বাভাবিক আছে বলে মনে করেন তিনি।