Homeঅর্থনীতিভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে সরবরাহে কারসাজি?

ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে সরবরাহে কারসাজি?


অনেক দিন ধরেই বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ সংকট; কখনও বোতলজাত, আবার কখনও খোলা তেলের। সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে বেশি দামে বিক্রি করছেন সয়াবিন ও পাম তেল। কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়বে নিশ্চিত, তাই সরবরাহ বন্ধ। দাম বাড়লেই দুই-চার দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে বাজার। রাজধানীর পাইকারি বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে এক লাফে ১৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকেরা। ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। যা ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিল মালিকরা। কিন্তু ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

ঈদের ছুটি শেষে গত ৬ এপ্রিল রবিবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে বৈঠকে বসেন সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী দেশীয় মিল মালিকেরা। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরেও ওই বৈঠকটি কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। একদিন বাদ দিয়ে ৮ এপ্রিল মঙ্গলবার আবারও ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকরা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকেও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে নকশা অনুযায়ী সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়াতে না পেরে কিছুটা হতাশ পরিশোধনকারী মিল মালিকরা। দাম বাড়ানোর আশায় আগে থেকেই মিলগেট থেকে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই দুটি বৈঠকে অংশ নেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) দফতরের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রাজ্জাকসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিসহ ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকেরা। বেশ কিছু সময় বৈঠক চললেও দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, এক লাফে তেলের দাম ১৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে আমদানি পর্যায়ে শুল্ককর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে দাম সহনীয় রাখতে আমদানি পর্যায়ের অব্যাহত শুল্ক-কর রেয়াত ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। মিলাররা জানিয়েছিলেন, শুল্ক-কর রেয়াত সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

দাম বাড়ানোর যুক্তি উপস্থাপন করে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, শুল্ক ছাড়ের এই সুবিধা উঠে গেছে। এই মুহূর্তে আমরা আগের অধিক হারে শুল্ক ও কর দিয়ে তেল আমদানি করছি। তাই তেলের দাম না বাড়লে কোম্পানিগুলো লোকসানে পড়বে। কারণ বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী।

বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর আশায় বাজারে সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন মিল মালিকেরা। এমন অভিযোগ করে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সয়াবিন ও পাম তেল নিয়ে খেলায় মেতেছেন দেশীয় আমদানিকারক মিলাররা। সারা দেশ যখন ঈদের ছুটিতে থাকবে, সেই সুযোগে সয়াবিনসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর নীলনকশা তৈরি করেছিলেন তারা। তারা গত ১ এপ্রিল থেকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৮ টাকা বাড়ানোর সব আয়োজন সমাপ্ত করেছিলেন। এই প্রক্রিয়া সহজ করতে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগে শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন বরাবর লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

জানা গেছে, এ বছর মার্চে রোজা শুরু হওয়ার আগে ফেব্রুয়ারিতে সয়াবিনের বাজার অস্থির হয়ে উঠলে দাম সহনীয় রাখতে সরকার ভোজ্যতেলের শুল্ক ও কর-এ যে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছিল, তার মেয়াদ গত ৩১ মার্চ সোমবার শেষ হচ্ছে। সেই হিসাবে শুল্ক-কর অব্যাহতির সুবিধা শেষ হয়ে গেছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারের দেওয়া কর রেয়াতের সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীরা তার পরের দিন অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকেই লিটারে ১৮ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন সয়াবিন তেল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, আমদানি রফতানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ট্যারিফ কমিশন ও বন্দর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৫ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮০ টন ও পামতেল ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৪৪ টন। এর মধ্যে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। এছাড়া, গত জানুয়ারিতে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। গত এক বছরে এত বেশি সয়াবিন বীজ আমদানি হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সেই সময়ে আরও ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৬৬ টন তেল আমদানি পাইপলাইনে ছিল। যা রোজার মধ্যে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে সয়াবিনের কোনও সংকট হওয়ার কথা নয়। তারপরও সরকার ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে গত ১৬ ডিসেম্বর সয়াবিন, পাম অয়েল আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই সুবিধায় আমদানি করা সব সয়াবিন বা পামতেল ৩১ মার্চের মধ্যরাতে শেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। তারপরও ১ এপ্রিল থেকে যদি আগের হারে শুল্ক ডিউটি ও ভ্যাট দিয়ে যদি সয়াবিন বা পাম তেল আমদানি করতে হয়, সেই তেল দেশে এসে পৌঁছতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৪৫ দিন। এর পরে আমদানিকৃত সয়াবিন বা পাম তেল পরিশোধন করে বাজারজাত করতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও তিন থেকে চার দিন। সেই হিসেবে যদি দাম বাড়াতেও হয় তা কার্যকর হওয়ার যৌক্তিক সময় হবে ৪৫ দিন পরে অর্থাৎ ১৫ মে’র পরে। অথচ ঈদের ছুটির সুযোগে ভোজ্যতেল আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা ১ এপ্রিল থেকে লিটারে ১৮ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করার নেশায় ছিলেন।

ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত দাম অনুযায়ী প্রতি লিটার ১৮ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৩ টাকা, যা আগে ছিল ১৭৫ টাকা। আর খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের লিটার ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, যা আগে ছিল ১৫৭ টাকা। আগামী ১ এপ্রিল থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে বলে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মো. বিপ্লব হোসেন জানিয়েছেন, পুরো রোজার মাসেই কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলের সরবরাহ নিয়ে টালবাহানা করেছে। এখনও করছে। কোম্পানির লোক এসে বলে গেছেন, দাম লিটারে ১৮ টাকা না বাড়লেও কম করে হলেও লিটারে ১০ টাকা বাড়বে। তাই সরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে গেলেই বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

এদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো ঠিকভাবে ডিও দিচ্ছে না। তাই বাজারে সয়াবিনের সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় ভোজ্যতেলের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে অনেক দিন ধরেই। সামনে কোরবানির ঈদ, তাই সরকার তেলের দাম না বাড়ালে মিল মালিকরা বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে দেবে বলে মনে হয় না।

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সময়ে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ যদি আরও কিছু দিন বাড়ানো হতো। তাহলে দাম আগের মতোই থাকতো। শুল্ক-করের রেয়াতি সুবিধা উঠে গেছে, এতে আমদানির খরচ বাড়ছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া আর উপায় নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রোজা শুরুর আগে থেকেই কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেল সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করে রেখেছিল। যা এখনও বিদ্যমান। সরবরাহে ঘাটতি না থাকা স্বত্বেও সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না। কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তাও জানি না। বাজারে ভোজ্যতেলের অস্থিরতা কাটছেই না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক অমিতাভ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহে কোনও জটিলতা নাই। আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলে দেওয়া শুল্ক ও কর রেয়াতি সুবিধা আবার দেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, দেশে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ২০ থেকে ২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত