চলতি অর্থবছরের মাত্র তিন মাস বাকি থাকলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে এখনো খরচ করা বাকি রয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে খরচ হয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা, যা মোট সংশোধিত এডিপির ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাকি সময়ে এত বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করা কার্যত অসম্ভব।
নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, যেখানে মূল এপিপিতে ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি। আর এই কাটছাঁটের পরও শেষ সময়ে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে, তা আগের ৯ মাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
তবে পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে, বাস্তবায়নের গতি যেভাবে চলছে, তাতে আগামী তিন মাসে আরও সর্বোচ্চ ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। অর্থাৎ বাস্তবায়ন ঘাটতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে। এরই মধ্যে আইএমইডি জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর এবারের ৯ মাসে অর্থছাড় সবচেয়ে কম হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্পের ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন। সেই সময় থেকে অনেক ঠিকাদার সাইট ছেড়ে চলে গেছেন, অনেক প্রকল্পে কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে ব্যয় কমেছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নেও ধস নেমেছে। যদিও মার্চ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে কিছুটা গতি ফিরে এসেছে, তবে তা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যথেষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন আল রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিল তৈরি হলেও অনেক জায়গায় এখনো পরিশোধ হয়নি। এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেওয়া হচ্ছে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার স্বার্থে। তবে কোনো বছরই বাজেটের পুরো অর্থ ব্যয় হয় না। তাই তিনি সতর্ক করে দেন, শেষ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টায় তাড়াহুড়ো করে খরচ করতে গিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও অপচয়ের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমনটি না হওয়াই ভালো। বরং এতে প্রকল্পের কাজের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জানান, কম অর্থছাড়, সংকুচিত আর্থিক কাঠামো এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের অগ্রাধিকার কমিয়ে দেওয়ার কারণে এডিপি বাস্তবায়নে এমন ধীরগতি দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রকল্প চাহিদা এ বছর তুলনামূলক কম, যার ফলে বরাদ্দ থাকলেও অর্থের চাহিদা কমে গেছে।
অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট থেকে এ বছর ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে এনইসি সভায়। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে থোক বরাদ্দ হিসেবে, যা অতীতের তুলনায় সর্বোচ্চ। এই বরাদ্দও যথাযথভাবে ব্যবহার না হওয়ায় খরচের ঘাটতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ (১৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা), বিদ্যুৎ বিভাগ (১৩ হাজার ৮৬৬ কোটি) এবং সড়ক মহাসড়ক বিভাগ (৮ হাজার ৬ কোটি)। অথচ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ খরচ করেছে ৫২ কোটি আর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ৮১৭ কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের বরাদ্দের এক টাকাও খরচ হয়নি।
সব মিলিয়ে এবারের এডিপি বাস্তবায়ন একদিকে যেমন কাঠামোগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার শিকার, তেমনি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের ফলেও সীমিত হয়েছে খরচের গতি। শেষ সময়ে খরচের চাপ একদিকে যেমন বড় অঙ্কের অর্থছাড়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে, তেমনি দুর্নীতি এবং কাজের মান নিয়ে শঙ্কাও বাড়ছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।