চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মূল বাজেটে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল বাজেটের তুলনায় এডিপির আকার ১৮ শতাংশ কমে গেছে, যা টাকার অঙ্কে ৩৮ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকার সমান। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বলছে, মূল এডিপি থেকে সাধারণত আরএডিপিতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বরাদ্দ কমানো হয়, তবে এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমানোর হার তুলনামূলক একটু বেশি হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় এই আরএডিপির প্রস্তাব চূড়ান্ত হবে। সভার সভাপতিত্ব করবেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব, সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। এরপর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) এই প্রস্তাব অনুমোদন করবে, যেখানে সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কমিশনের তৈরি চূড়ান্ত আরএডিপির খসড়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণত প্রতিবছর তিনটি ভাগে এডিপি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আরএডিপির ক্ষেত্রেও একই নিয়মে তিন ভাগ থেকেই টাকার অঙ্ক কমানো হয়েছে। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশন তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার মোট পরিমাণ ১০ হাজার ১২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এরপর সরকার নিজেদের তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্পগুলো অর্থায়ন করবে। আর বিদেশি ঋণ বা অনুদান দিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তার জন্য ৮১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছরে মোট আরএডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, যার পরিমাণ ৪৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ৩১ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা নিয়ে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে শিক্ষা খাত, যেখানে বরাদ্দ ২০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ, যার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বরাদ্দ ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
সংশোধিত উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাওয়া অন্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে—গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ১৯ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৬ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ৮ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আর মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিবেচনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। পানিসম্পদের বরাদ্দ ১০ হাজার ২১১ কোটি টাকা, নৌপরিবহনে বরাদ্দ ৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, সেতু বিভাগের বরাদ্দ ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরএডিপি বিষয়ে বলেন, ‘প্রতিবছর মার্চে উন্নয়ন বাজেট সংশোধন করা হয়। আমরা এটি আরও এগিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং জনগণের উপকার করা। এই সংশোধনীতে অবকাঠামোর চেয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের ব্যয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছ বেশি। এ ছাড়া দেশীয় অর্থায়নের চেয়ে বিদেশি অর্থ ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ২০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা, সংশোধনে ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, সারা দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার চলমান প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন করেছে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত কিছু প্রকল্প বাতিল করেছে, যার ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ কমে গেছে। একই সঙ্গে নতুন প্রকল্প অনুমোদনের আগে কঠোর যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং অতিমূল্যায়িত প্রকল্প অনুমোদনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। এতে আরএডিপি কমার হারও বেশি হয়েছে।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে লক্ষ করা গেছে। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এডিপি থেকে মোট ৫৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই সময়ে এই হার ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এডিপি বাস্তবায়নে এটাই সবচেয়ে কম হার। করোনা মহামারির সময়েও এতটা নিম্ন হার দেখা যায়নি।