ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৭ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭.৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৬.৫৪ লাখ কোটি টাকা।
টানা দশ মাস ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকার পর ধীর গতিতে হলেও গত চার মাস ধরে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করছে এসব টাকা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসেই ব্যাংকে ফিরেছে ১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, নভেম্বর শেষে মানুষের হাতে ছিল ২.৭৭ লাখ কোটি টাকা ছিল। ডিসেম্বর শেষে সেটি কমে ২.৭৬ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় এটি প্রায় ৮.৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২.৫৫ লাখ কোটি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়। কারণ, ব্যাংকের বাইরে থাকলে টাকার হাতবদল হওয়া কমে যায়, যা দিনশেষে ‘মানি ক্রিয়েশন’ কমিয়ে দেয়। মানুষের হাতে থাকা টাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংকে ফিরলে একদিকে যেমন ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো হয়, অন্যদিকে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের পরিমাণ বাড়ায় দেশে বিনিয়োগ বাড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করায় এবং সুশাসন বাড়ায় ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ গত কয়েক মাস ধরে কমছে। এটা পুরো অর্থনীতির জন্যই একটা ভালো লক্ষণ।
‘তবে ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের শুরুর দিকে এর পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ যে হারে বেড়েছে, বর্তমানে তার চেয়ে কম হারে ব্যাংকে সেগুলো ফেরত আসছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতিজনিত চাপের কারণে এরপর থেকে প্রতি মাসেই এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। পরে গত বছরের জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২.৯২ লাখ কোটিতে পৌঁছায়।
তবে বেশ কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়াসহ নানা কারণে আগস্টে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ খুব বেশি বাড়েনি। সেপ্টেম্বর থেকে ফিরতে শুরু করে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা।
এদিকে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশামাফিক হচ্ছে না। টানা তিন মাস প্রবৃদ্ধির হার অল্প করে বাড়লেও ডিসেম্বরে সেটি আগের মাসের তুলনায় কমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৭ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭.৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৬.৫৪ লাখ কোটি টাকা।
গত আগস্টে আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল আগের ১৮ মাসের সর্বনিম্ন, ৭.০২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করে। ওই মাসে আমানত বাড়ে ১৪ হাজার ২০৮ কোটি টাকা বা ৭.২৬ শতাংশ।
অক্টোবরে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয় ৭.২৮ শতাংশ, আমানত দাঁড়ায় ১৭.৫৫ শতাংশ। নভেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা বেড়ে ৭.৪৬ শতাংশ হয়।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার বেশ কিছু ঘটনা নজরে আসার পর গ্রাহকদের আস্থাহীনতাই এই কম আমানত প্রবৃদ্ধির কারণ। পাশাপাশি দূর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা তাদের আমানতের টাকা ঠিকমতো ফেরত না পাওয়ায় খাতটি নিয়ে আতঙ্ক বেড়ে যায়।
আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তত ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়া, বেনামী ঋণ ইস্যু ঠেকানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এতে সবগুলো দুর্বল ব্যাংকের অবস্থা খুব বেশি ভালোর দিকে না গেলেও খারাপের দিকে যাওয়া ঠেকানো গেছে। এছাড়া ইসলামী ও ইউসিবি ব্যাংকের অবস্থা আগের তুলনায় ভালো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন গভর্নর। একইসঙ্গে ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়তে থাকায় এই ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে।
২০২৪ সালে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হয়েছে মন্তব্য করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভালো ব্যাংকগুলো ইন্ডাস্ট্রি অ্যাভারেজ থেকে বেশি হারে আমানত পাচ্ছে এটা যেমন সত্য, আরেকদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোও সেভাবে ডিপোজিট পাচ্ছে না। আমানতের সুদহার বাড়ানোর পরও ইন্ডাস্ট্রি অ্যাভারেজ আমানত প্রবৃদ্ধিকে খুব বেশি ভালো বলা যাবে না। এর অন্যতম কারণ চলমান মূল্যস্ফীতি।
‘অফিশিয়ালি প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বলা হলেও বাস্তবে তা আরও বেশি বলে আমার ধারণা। গত দুই বছর ধরে যে হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, মানুষের আয় কিন্তু সে হারে বাড়েনি। ফলে এমন অনেক গ্রাহক আমরা পাচ্ছি, যারা ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে বাড়তি খরচ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’