বহুল আলোচিত ইতালীতে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় আটকে নির্যাতন করে মুক্তিপণ দাবি ও মৃত্যুর ঘটনায় ২টি পৃথক মামলার এজাহারনামীয় অন্যতম আসামি লিপন মাতুব্বর ও আনোয়ার ওরফে আনো মাতব্বরকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে বেকার যুবকদের ইতালীতে উন্নত জীবন যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে ইতালী নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় আটকে নির্যাতন করে মুক্তিপণ দাবি ও মৃত্যুর ঘটনা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। র্যাব ফোর্সেস উক্ত ঘটনার রহস্য উন্মোচনসহ ঘটনার সাথে জড়িত মানব পাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মাদারীপুরের রাজৈরের ইতালীতে গমনকৃত কতিপয় ব্যক্তিদের মৃতদেহের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট আদম ব্যবসায়ীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে আদম ব্যবসায়ীরা তাদেরকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করে এবং আত্মগোপনে চলে যায়।
পরবর্তীতে উক্ত ঘটনায় মিন্টু হাওলাদার বাদী হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এ ০১টি মামলা দায়ের করেন; যার মামলা নং-৫, তারিখ ০২ ফেব্রæয়ারি ২০২৫, ধারাঃ ৬(২)/৭/১০ এবং নাজমিন বেগম বাদী হয়ে মাদারীপুরের রাজৈর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এ ০১টি মামলা দায়ের করেন; যার মামলা নং-১৩, তারিখ: ১০ ফেব্রæয়ারি ২০২৫; ধারাঃ ৬(২)/৭/৮(২)/৯/১০।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-৩ ও র্যাব-১০ এর যৌথ আভিযানিক দল রাজধানীর ভাটারা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মাদারীপুরের রাজৈর থানার মানব পাচার মামলার এজাহারনামীয় প্রধান আসামি লিপন মাতুব্বর (৩৫) পিতা: আব্দুর রহমান মাতুব্বর, রাজৈর, মাদারীপুর এবং অদ্য সকাল ০৯.০০ ঘটিকায় ও ঢাকার দোহার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার মানব পাচার মামলার এজাহারনামীয় প্রধান আসামি আনোয়ার ওরফে আনো মাতুব্বর (৪৫), পিতাঃ মৃত রাজ্জাক মাতুব্বর, ভাঙ্গা, ফরিদপুরদেরকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা মানবপাচারের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত লিপন মাতুব্বর (৩৬) এর ভাই তপন ওরফে মাসুদ মাতুব্বর একজন লিবিয়া প্রবাসী। লিপন মাতুব্বর তার ভাই এর মাধ্যমে অবৈধ পথে লিবিয়া হয়ে ইতালীতে লোক পাঠাতো বলে জানায়। গ্রেফতারকৃত লিপন ইতালীতে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইতালী গমন প্রত্যাশী সদস্যদের সংগ্রহ করতো। তিনি জন প্রতি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে ১৬ লাখ টাকা চুক্তি করতো। বিভিন্ন ধাপে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতো। তারপর তাদেরকে মাদারীপুর থেকে সার্বিক নামক বাসযোগে মাদারীপুর হতে ঢাকা শাহাজালাল আন্তজার্তিক এয়ারপোর্টে নিয়ে আসতো। পরবর্তীতে গ্রেফাতারকৃত লিপন ঢাকা এয়াপোর্টে পূর্ব হতে অবস্থান করা দালাল চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে ভিকটিমদেরকে হস্তান্তর করতো। পরবর্তীতে তারা অবৈধ পথে লিবিয়া নিয়ে তাদেরকে আটকে অমানবিক নির্যাতন করে ভিডিও ধারন করে রাখতো। পরবর্তীতে উক্ত নির্যাতনের ভিডিও ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে পাঠিয়ে টাকা দাবী করতো। টাকা পাওয়ার পর তাদেরকে ভূমধ্যসাগরে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তুলে দেওয়া হতো। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবির ঘটনায় অনেকে মারা যেতো বলে জানা যায়। এছাড়াও তাঁদের অমানবিক নির্যাতনের কারণে অনেকেই মারা গেছে বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত লিপন একজন ইতালী গমণ প্রত্যাশী সংগ্রহের বিনিময়ে ১০-১৫ হাজার টাকা করে পেতো বলে জানায়। গ্রেফতারকৃত লিপন মাতুব্বর পেশায় একজন রং মিস্ত্রি। তিনি রাজধানীর ভাটারা এলাকায় বসবাস করতো। সে বিগত ৩-৪ মাস যাবৎ মানপাচার চক্রটির সাথে জড়িত। সে এ পর্যন্ত ৬-৭ জনকে ইতালী পাঠানোর উদ্দেশ্যে লিবিয়াতে প্রেরণ করেছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত আনো মাতুব্বরকে (৪০) জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আনোয়ার ও ভিকটিম হৃদয় একই এলাকার বাসীন্দা। ভিকটিম হৃদয় হাওলাদার বাড়ীতে বেকার থাকায় গ্রেফতারকৃত আনোয়ার তাকে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ২ মাসের মধ্যে ইতালীতে পাঠানোর প্রস্তাব দিলে ভিকটিম হৃদয় তার প্রস্তাবে রাজী হয়। পরবর্তীতে ভিকটিম হৃদয়ের বাবা গত ০১ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ গ্রেফতারকৃত আনোয়ারকে নগদ ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং হৃদয়ের পাসপোর্ট প্রদান করে। পরবর্তীতে গত ২৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ গ্রেফতারকৃত আনোয়ার এবং ভিকটিম হৃদয় হাওলাদার ইতালী যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসে এবং একই দিনে লিবিয়া গমন করে। কিন্তু ভিকটিম হৃদয় লিবিয়া যাওয়ার পর মোবাইলের মাধ্যমে পরিবারকে জানায় যে, তাকে সেখানে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং অবশিষ্ট ১৫ লক্ষ টাকা না দিলে তার ক্ষতি হবে। উপায়ান্তর না পেয়ে ভিকটিম হৃদয়ের পরিবার গত ২৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ গ্রেফতারকৃত আনোয়ার এর নিকট বাকী ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান করে। টাকা প্রদানের কয়েক দিন পর ভিকটিম হৃদয় পরিবারকে জানায় যে, লিবিয়ায় থাকা চক্রের অন্যান্য সদস্যরা তাকে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করছে। ভিকটিমের বাবা গ্রেফতারকৃত আনোয়ারের বাড়ীতে গিয়ে হৃদয়কে নির্যাতনের কথা জানালে সে আরো ১০ লক্ষ টাকা দাবী করে এবং টাকা না দিলে হৃদয়কে ইতালী পাঠানো যাবে না বলে জানায়। ভিকটিমের পরিবার ছেলের কথা চিন্তা করে পুনরায় গ্রেফতারকৃত আনোয়ারের নিকট আরো ৫ লক্ষ টাকা প্রদান করে। পরবর্তীতে গত ২২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখ রাত অনুমান ০৮.১০ ঘটিকার সময় হৃদয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারকে জানায় যে, লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের অন্যান্য সদস্যরা তাকে লিবিয়ার সাগরপাড়ে নিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও হৃদয় আরো জানায় তার কোন ক্ষতি হলে গ্রেফতারকৃতরা যেন কোনভাবেই ছাড় না পায়। উক্ত তারিখের পর হতে হৃদয় এর সাথে পরিবারের আর কোন যোগাযোগ হয়নি। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৃদয়ের মৃতদেহের ছবি দেখতে পায়।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
এ ইউ/