বিশ্বের অনেক দেশেই অভিবাসন প্রত্যাশীরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। যদিও এর মধ্যে বড় একটা অংশের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। এখন সেই বিষয়টি আরও দ্রুত গতিতে হবে এবং আবেদন নাকচ হলে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশসহ সাতটি দেশকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ায় এসব দেশের নাগরিকদের ইউরোপে আশ্রয় পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে ধারনা করা হয়।
ইউরোপীয় কমিশনের মার্কুস লামার্ট বলেছেন, এটি একটি ‘ডায়নামিক’ বা ‘গতিশীল তালিকা’ হবে, যা সময়ে সময়ে পর্যালোচনা ও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে এবং কোনো দেশকে নিরাপদ না মনে হলে, তা স্থগিত বা বাদ দেওয়া যেতে পারে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, যেসব দেশের নাগরিকদের আশ্রয়প্রাপ্তির হার কম, সেসব দেশের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে আশ্রয়প্রাপ্তির হার মাত্র ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ— যা ইইউ নির্ধারিত ২০ শতাংশের চেয়েও অনেক নিচে। ফলে বাংলাদেশিদের আবেদন দ্রুত খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।
কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক ও অভিবাসন কমিশনার জানিয়েছেন, ‘যেখানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সেখানে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।’ এ প্রক্রিয়ার ফলে আবেদনকারীদের ইউরোপে অবস্থানের সময়ও অনেক কমে আসবে।
ইউরোপীয় কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক ও অভিবাসন কমিশনার ম্যাগনাস ব্রুনার বলছেন, যেখানে আমরা দ্রুত এগোতে পারি, সেখানে আমাদের আরও দ্রুত এগিয়ে যাওয়া উচিত। অনেক সদস্য রাষ্ট্রে আশ্রয় আবেদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জমা পড়ে (আটকে) রয়েছে, ফলে আমরা আশ্রয়ের সিদ্ধান্ত দ্রুতগতিতে নিতে যেভাবে সহযোগিতা করা সম্ভব তা করাটা অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিদের জন্য বড় ধরণের প্রভাব ফেলবে। অভিবাসন বিশ্লেষক শরীফুল হাসান বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে যারা প্রকৃত সংকটে রয়েছেন, তাদের জন্যও আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ও অন্যান্য দেশে প্রবেশের হার বেড়েছে। ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, ৪৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি আশ্রয়ের আবেদন করেন, যার একটি বড় অংশই বর্তমানে ঝুলে রয়েছে।
ইউরোপে অনেক সাধারণ বাংলাদেশি যারা হয়তো কাজের জন্য যাচ্ছে বা সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে গিয়েছেন, সেখানে গিয়ে তারা বলেছেন- আমি আমার দেশে নিরাপদ নয়। ইউরোপ দেখেছে যে, বেশিরভাগ বাংলাদেশি ‘নিরাপদ না’ বলার যে কারণগুলো দেখাচ্ছেন, সে কারণগুলো আসলে সঠিক নয়। যেসব কারণে তারা ৯০-৯৫ ভাগ খারিজ করে দিয়েছেন।
ইইউর এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে— গত বছর গৃহীত ‘অভিবাসন ও আশ্রয় চুক্তি’র দ্রুত বাস্তবায়ন। চুক্তিটি ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও ইইউ দুটি নিয়ম আগেই কার্যকর করতে চায়। এর একটি হলো- যে সব দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা পাওয়ার হার কম, তাদের আবেদন ‘সীমান্ত প্রক্রিয়ায়’ দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। দ্বিতীয়ত, ‘নিরাপদ দেশ’ হিসেবে নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সার্বিকভাবে তালিকাভুক্ত করা যাবে।
বর্তমানে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এই প্রস্তাব। অনুমোদন পেলে বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপে আশ্রয়ের দ্বার আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর ফলে এখন সত্যিকারের যারা সংকটে পড়েছেন, তাদের জন্য ‘বাংলাদেশকে নিরাপদ’ ঘোষণার কারণে আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ্বজুড়েই অভিবাসনের জন্য আগ্রহের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর অনেকেই এ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যুক্তরাজ্যও অভিবাসন রোধে কঠোর ভিসা নীতির পরিকল্পনা নিয়েছে।
জার্মানিসহ অন্যান্য কিছু দেশ অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ইতালিসহ ইউরোপের কয়েকটি সদস্য দেশ ইতোমধ্যেই নিরাপদ দেশের তালিকা তৈরি করেছে। এবার ধারণা করা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সম্মত তালিকা থাকলে, যেসব সদস্য দেশে নিয়ম শিথিল পর্যায়ে আছে, সেসব দেশগুলোকে টার্গেট করে তাদের নিরুৎসাহিত করা যাবে।
ইতালির ডানপন্থি সরকারপ্রধান জর্জিয়া মেলোনির সরকার ‘নিরাপদের’ এই তালিকাকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি বাংলাদেশ, মিশর ও তিউনিসিয়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে রোমের জন্য একটি সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এর আগে মিশরীয় ও বাংলাদেশিদের আলবেনিয়ার বন্দিশালায় পাঠানোর মি. মেলোনির পরিকল্পনাকে আটকে দিয়েছিল ইতালির বিচারকরা। কারণ হিসেবে ইউরোপীয় বিচার আদালত জানায়, রোম সরকার এই দেশগুলোকে নিরাপদ মনে করলেও যদি দেশটির সব অঞ্চল ও সংখ্যালঘুদের নিরাপদ না মনে করা যায়, তাহলে সেটি নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
নতুন প্রস্তাবগুলো এখন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কিছু মানবাধিকার সংগঠন এই পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ইউরোমেড রাইটস সতর্ক করেছে, এই সাতটি দেশকে নিরাপদ বলা বিভ্রান্তিকর এবং বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এদের মধ্যে এমন দেশ আছে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ রয়েছে এবং নাগরিক ও অভিবাসীদের জন্য নিরাপত্তা সীমিত।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এম এইচ/