Homeপ্রবাসের খবরবাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন  

বাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন  


কানাডার কেলগেরিতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর আন্তরিকতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়েছে। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) নগরীর রেনফ্রিউ কমিউনিটি হলে এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরি (বিএসসি)।

আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ‍্যে ছিলেন নগরীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত কমিউনিটির সদস‍্যরা, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশার নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর। যারা এসেছিলেন তারা হলেন কেলগেরি নগরীতে বসবাসরত ১০টি দেশের কমিউনিটির সদস‍্যরা। হরেক রংয়ের জাতীয় পোশাকে সুসজ্জিত আগত অতিথিদের সমাগমে কমিউনিটি সেন্টারটি বর্ণময় হয়ে ওঠে। প্রায় তিন শতাধিক মানুষের আগমনে এক মুগ্ধময় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক মিলন ভূমিতে পরিণত হয় রেনফ্রিউ কমিউনিটি হল। এ যেন একই বৃন্তে অনেকগুলো কুসুমকলিকে বেঁধে নেওয়ার এক মহাপ্রয়াস।

প্রথমে নগরীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ সুসজ্জিত শহীদ বেদীতে পরম শ্রদ্ধায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় বেজে ওঠে গভীর আবেদনময় সেই বিখ‍্যাত সুরের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গান। বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন‍্যান্য দেশের ভাষায়ও গানটি সুর ছড়িয়ে যেতে থাকে পরম মমতায়। বিএসসির একজন ডিরেক্টর হাসান আব্বাসের সুনিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি ও সাজানো শহীদ বেদী বর্ণিল পুষ্পস্তবকে আরও আকর্ষণীয় ও বর্ণময় হয়ে ওঠে।

অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হয় কানাডা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ‍্য দিয়ে। এ সময় হল রুমে সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। পরক্ষণেই সুকণ্ঠি সঞ্চালিকা নাহিদ চৌধুরী কনক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করেন। এরপর অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক বিএসসির ডিরেক্টর ওবায়দুর রহমানকে তার স্বাগত বক্তব্য রাখার জন‍্য অনুরোধ করেন সঞ্চালিকা। রহমান প্রথমেই তার বক্তব‍্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে ভাষার জন‍্য বাংলা মায়ের যেসব দামাল সন্তানরা আত্মাহুতি দেন তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। তারপর অতিথিদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান অনুষ্ঠানে আন্তরিক অংশগ্রহণের জন‍্য।

অতিথিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আজ এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদেরকে আলোকিত করেছেন। আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আপনাদের মাধ‍্যমে আজ আমরা পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে সমৃদ্ধ হবো। তিনি তার বক্তব্যে বহুভাষিক বৈচিত্র্য এবং বহু সাংস্কৃতিক ঐত‍িহ‍্যের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন।

সঞ্চালিকা অনুষ্ঠানের অতিথি কেলগেরি ৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজ ধালিওয়ালকে বক্তব‍্য রাখতে অনুরোধ করেন। তিনি তার বক্তব‍্যে বাংলাদেশের ভাষা শহীদের স্মরণ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্ববাসীকে উপহার দেওয়ার জন‍্য বাংলাদেশের অবদানের প্রতি সম্মান জানান। তিনি কমিউনিটির উন্নয়নে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

এরপর পযাক্রমে আফাগানিস্তান, বাংলাদেশ, কানাডা, চায়না, ইরিথ্রিয়া, ইন্ডিয়া, লেবানন, নেপাল, পেলেস্টাইন, রাশিয়া ও থাইল‍্যান্ডের সাংস্কৃতিক গ্রুপগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করে।

আফগানিস্তান তাদের ঐতিহ্যবাহী আফগান পাঞ্জাবি পোশাকে সজ্জিত একদল যুবক তাদের বিখ‍্যাত ছন্দময় নৃত‍্য আফগান সংগীতের তালে তালে উপস্থাপন করে। আফগান রমণীর সুন্দর সাজে অর্থাৎ মাথায় লাল দুপাট্টা এবং লাল কালোর সংমিশ্রণে সালোয়ার কামিজে সুসজ্জিতা হয়ে মঞ্চে আসেন এক সুদর্শনা। সাথে সহ পারফরমার। আবৃত্তি করেন ১৩ শতকের বিখ‍্যাত পারসিয়ান কবি জালাল আল-দিন মোহাম্মদ রুমির কবিতা থেকে অংশবিশেষ।

কানাডিয়ান নেটিভ সোসাইটির প্রাণবন্ত সদস‍্যা অপরুপ সুরে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করেন নেটিভ সংগীতের এক বিচিত্র সুরের সুমধুর মূর্ছনা। যা ক্ষণকালের জন‍্য শ্রোতাদের নিয়ে যায় সেই নির্জন পাহাড়ি জীবনের লীলাভূমে। যেখানে প্রকৃতি আর জীবন মিশে ছিল একাকার হয়ে।

চীনা দলটি বিভক্ত ছিল দুটি অংশে। বসন্তের পলাশ রাঙ্গা রংয়ের আবরণে সেজেছিল চৌদ্দ জন নৃত‍্যশিল্পী। যাদের মধ‍্যে তিনজন নারী ছিলেন সত্তর বছরের কাছাকাছি বয়স। অসম্ভব গতি, নৃত‍্যকৌশল আর তালে সম্পন্ন নৃত‍্যে যেন বার বার বসন্তের অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল পুরো হলরুম। মন্ত্রমুগ্ধের মত গোটা হল হারিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন‍্য এই নৃত‍্যের গহন গভীরে। অন‍্যদলে দুই কিশোরী বোন চাইনিস সুরে সাজিয়ে তোলে আলোকোজ্জল হল রুমের পরিবেশকে।

ইরিথ্রিয়ার জাতীয় পোশাকে সুসজ্জিতা ইরিথ্রিয়ান তিনকন‍্যা সুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিছুক্ষণ। মানব জীবন ও সভ‍্যতার বিকাশে ভাষা বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর বাণীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ইন্ডিয়ান অংশগ্রহণকারী। লেবাবনন ও পেলেস্টাইনের পোশাকে সজ্জিত দুই শিল্পীর একজন গেয়েছেন সেই অঞ্চলের শক্তিশালী সুরের গান। আর অপরজন বেহালায় তুলেছেন প্রাণকাড়া সুর। নেপালি সুন্দরী কন‍্যার সেই পাহাড়ঘেরা শ‍্যামলভূমির ছন্দময় নৃত‍্যে আর ছোট্ট কন‍্যার সংগীত পরিবেশন মন কেড়ে নেয় সবার। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ যেন কন‍্যার নৃত‍্যে এসে দাঁড়ায় পথ আগলে কানাডার সুজ্জিত এই হলরুমে।

ফিলিপাইনের ১২ জন কন‍্যার সুসজ্জিত নৃত‍্যের পোশাকে আগাগোড়া সাজানো দলটি আবার চাইনিস নৃত‍্যের মতো শক্তিশালী নৃত‍্য পরিবেশন করে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। মুহূর্তের তরে যেন সবাই তাদের নৃত‍্যের তালে তালে বার বার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছিল। অর্থাৎ তাদের নৃত‍্যশৈলী দর্শকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে।

রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিতা রাজকুমারীর অবয়বে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ায় উঁচু ফিগারের সুন্দরী রাশিয়ান কন‍্যা। রাশিয়ান কথার বর্ণময়তায় ও কবিতার ছন্দময়তায় সাজে তার জন‍্য নির্ধারিত সময়। থাই সংগীতের সুরেলা মূর্ছনায় আবার সেজে উঠে মঞ্চ আঙ্গিনা। তিনজনের দলে অভিজ্ঞ দলনেতার সাথে সুরের আলপনা সাজিয়েছেন সুরেলা কণ্ঠে দুই থাই কন‍্যা।

পরিশেষে বাংলাদেশ দল মঞ্চে আসে। তারা তাদের গিটার, বেহালা, হারমনিয়ামের সুরকে সাজিয়ে তুলে গান ও কবিতার ছন্দে। যা ছিল মূলত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কেন্দ্র করে। মায়ের প্রতীক্ষার করুণ আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাদের আয়োজনের পরতে পরতে।

সব দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একই মঞ্চে আয়োজনের মধ‍্য দিয়ে এই আসরটি যেন একটি বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চারণভূমিতে পরিণত হয়। সবার মনে এক বিনিসুতোর মালা যেন জড়িয়ে যায় অপূর্ব স্নিগ্ধতায়।

এ বছরটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন‍্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫তম বার্ষিকী। কারণ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্হা বা UNESCO ১৯৯৯ সালে আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এবছর এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সংস্থাটি বিভিন্ন ক্রোড়পত্র, পোস্টার এবং থিম বা ভাবনা প্রকাশ করে।

UNESCO থিম এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কানাডার বাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরি (বিএসসি) তার থিম এবং পোস্টার প্রকাশ করেছে। বিএসসি এর থিম হচ্ছে ‘ভাষা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার, বিশ্বের সব মানুষের এ অধিকার সুরক্ষিত হোক।’ সেইসাথে বিশেষ পোস্টারে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে ‘ভাষা হোক শান্তি ও সম্প্রীতির বাহক, হোক যুদ্ধ বন্ধের শান্ত বহিঃপ্রকাশ।’

এই সুন্দর আনুষ্ঠিনটির সফল বাস্তবায়নের জন‍্য বিএসসি’র চব্বিশ জন ডিরেক্টর কাজ করেছেন। বিশেষ করে গত একমাস ব‍্যাপী যে সমস্ত ডিরেক্টররা নিরলস কাজ করেছেন তারা হলেন- সায়মা মাওলা, মো. জাহিদুল হক, আনিসুর রহমান, মো. আলী আশরাফ লস্কর, আহমেদ আল-ইমরান নিক্কন, হাসান আব্বাস, মো. জামাল উদ্দিন, খলিলুর রহমান শম্পা, সজ্জাদ বিপুল, হাবিব ইসলাম হিরণ, ওবায়দুর রহমান ও শৈলেন কুমার দাশ। সেইসাথে যন্ত্রকৌশল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব‍্যবস্থাপনায় গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন বিএসসি ডিরেক্টর মামমুদুল হক খোকন ও সাজ্জাদ বিপুল।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত