সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮)। তাঁর প্রধানতম পরিচয় তিনি একজন বাঙালি নাট্যকার। বাংলা নাটকের প্রবাদপুরুষও বটে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ঈশ্বরের বর না পেলে তার মতো লিখতে পারা কেবল কঠিনই নয়, অসম্ভবও। কবি মাত্রই এক অসীম অন্তর্নিহিত শক্তির অধিকারী হন। সেলিম আল দীন কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন, লিখেছিলেনও। পরে বাঁক বদল করলেন। নাটক লিখতে শুরু করলেন। তিনি একের পর এক নাটক লিখলেন ঠিকই, তবে তার সে-সকল নাটকের অভ্যন্তরে কবিতার শক্তি, কবিতার দর্শন ও বিপুল অনুভব উপলব্ধ হলো। তার নাটকের বর্ণনার ভঙ্গিতে গীতময়তা প্রবল হয়ে উঠল। সংলাপ পাঠ ও শ্রবণে পাঠক ও দর্শকের ভ্রম হল, এই ভেবে যে—এই বুঝি কবিতা পড়ছি, বুঝি শুনছি গান। নাট্যকারের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পদর্শন একটি অভিন্ন জানালা দিয়ে বহুবর্ণিল শিল্পকে একবিন্দুতে টেনে এনে দেখার দিগন্ত প্রসারিত করল।
সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় তার লেখা বিখ্যাত নাটক হাত হদাই। নাটকের নায়ক আনার ভাণ্ডারি এক অসম্ভব শক্তিমান পুরুষ। আনারের পৌরুষ আর সংকল্পের কাছে হার মানে তার সময়, তার প্রতিশ্রুতি। সেলিম আল দীনের লেখা অন্যতম শক্তিশালী নাটক চাকা। ঘূর্ণায়মান চাকার সঙ্গে এক হতভাগ্য মৃতের দেহ গ্রামীণ পথ পেরোতে থাকে। পিঁপড়া দল বেঁধে সিঁধ কাটতে থাকে মৃতের শরীরে। চুঁইয়ে পড়ে লাল রক্তমিশ্রিত পানি। নাটকের বর্ণনা শুনতে শুনে দর্শকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মানুষ ভাবতে থাকে—কীভাবে এমন দৃশ্য আঁকলেন নাট্যকার। কেন আঁকলেন। হরগজ সেলিম আল দীনের ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের আখ্যান। ঝড়ের রাত কী বিভীষিকা বহন করতে পারে দুঃখিনী বাংলার মানুষ কেবল তা উপলব্ধি করতে পারে। নাট্যকার সেইসব ব্যথা-বেদনাকে চিত্রিত করেন নাটকে। ভাদ্রের বৃষ্টির স্যাঁতসেঁতে গন্ধ গায়ে মেখে জন্মানো সেলিম আল দীনের কাছে মানিকগঞ্জের যমুনা-কালিগঙ্গা নদী, গ্রাম, গ্রামের পথঘাটও অসম্ভব প্রিয় ছিল। তার নাটকের উপজীব্য বিষয় হিসেবে প্রান্তিক জনপদের মানুষ, নদীপাড়ের জনজীবন, হাট-বাজার বারবার ধৃত হয়। সেলিম আল দীন গ্রাম ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বনানি, বৃক্ষরাজি, জলাশয়, ঝড়-বৃষ্টি, নদী ও জল। তার লেখায় এসব শক্তিশালী অনুষঙ্গের উপস্থিতির যেমন আঁচ পাওয়া যায় তেমনি তার সাহচর্য যারা পেয়েছেন তাদের কথা আর উপলব্ধিতেও উঠে আসে এসব বিষয়-আশয়।
সেলিম আল দীন বাংলা নাটকে নব ধারার পথিক। শুরুতে তিনি ভীষণ একলা-ও। নাটকে বহুকাল ধরে পাশ্চাত্যের যে ধারা প্রচলিত ছিল—তিনি নাট্য রচনার সেই ঢং, রং ও কৌশলকে একপ্রকার প্রত্যাখ্যান করে নিজেই নব এক ধারার শুভ সূচনা করেন। সংলাপের পর সংলাপ জোড়া দিয়ে নাটকের কাহিনি অগ্রসর হওয়ার যে পাশ্চাত্য রীতি অনুকরণে বাংলা নাটক ক্লান্ত-ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছিল তিনি সেই নিয়ম-রীতির ব্যত্যয় না ঘটিয়ে ক্ষান্ত হলেন না। তার নাটকের কাহিনি-আখ্যান বর্ণনার ধারাবাহিকতায় আবর্তিত হল, অগ্রসর হল। নাটকের গল্প নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিজস্ব বয়ান হাজিরপূর্বক তিনি দেখালেন, এটিই বাঙালির ঐতিহ্যবাহী হাজার বছরের রীতি-ধারা। ফলে তিনি শুধু আর নাট্যকার রইলেন না, গবেষণার অতল সমুদ্রে নেমে পড়লেন। তিনি গবেষণা করলেন, তিনি দেখালেন, শিল্প-সাহিত্য-দর্শনে চিরকাল ইউরোপ আমাদের পথপ্রদর্শক নয়।
তিনি নাটক লিখলেন। তার রচিত নাটক কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান এবং স্বর্ণবোয়াল ঢাকার মঞ্চে, বাংলাদেশের মঞ্চে মঞ্চায়িত হল, হতে থাকল। চতুর্দিকে সেলিম আল দীনের নাটকে সুবাস ছড়িয়ে পড়লে সকলে সমস্বরে বলল সেলিম আল দীন রবীন্দ্রোত্তরকালের বাংলা নাটকের প্রধান বরপুত্র।
সেলিম আল দীন স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়ে পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। তিনি আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার প্রতিষ্ঠায়ও নেতৃত্ব দেন। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশনের জন্যও নাটক লিখেছেন। তার লেখা নাটক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকাভুক্ত।
বাংলা নাটকের এই খ্যাতিমান নাট্যকার বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৭ সালে একুশে পদক এবং ২০০৮ সালে কাগজ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।