Homeসাহিত্যডেভিড উয়েলের ‘আল্লাহর ইচ্ছা’

ডেভিড উয়েলের ‘আল্লাহর ইচ্ছা’


ডেভিড উয়েলে ছিলেন নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের ইয়োরুবা বংশোদ্ভূত লেখক এবং সরকারি কর্মকর্তা। তিনি তথ্যমন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করতেন। নাইজেরিয়ার সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখা তার ছোটগল্প ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে।

আকাশে ছিল এক স্বচ্ছ চাঁদ। এখন রাত গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। ডোগো আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখের সামনেই দ্রুত সঞ্চরণশীল কালো মেঘের দল আবৃত করে ফেলল চাঁদকে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে সঙ্গীর উদ্দেশ্যে সে বলল— ‘রাতে বৃষ্টি হবে,’। তার সঙ্গী সুল সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিল না। সুল লম্বা, শক্তপোক্ত গড়নের পুরুষ। তাদের দুজনের চেহারাতেই ছিল এক ভোঁতা বেপরোয়াভাবের মুখোশ সাঁটা। তারা দুজনেই ছিল চোর, আর এ মুহূর্তে সুলকে হাঁটতে হচ্ছিল এক অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে। ‘কাজে বেরিয়ে এসব বলা ঠিক না,’ সুল একটু বিরতি নিয়ে তার বাঁহাতের ওপরে বেঁধে রাখা লম্বা, বাঁকানো যে ছুরিটা থাকে, সেদিকে ইঙ্গিত করে। একই রকমের নির্মম একটি অস্ত্র তার সহকর্মীর হাতেও ছিল। ‘তুমি নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?’ ‘নিশ্চিত?’ ডোগো প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠে বিরক্তি এবং অধৈর্য স্পষ্ট। স্থানীয় ভাষায় “ডোগো” শব্দের অর্থ লম্বা। বিপরীতে সে ছিল মোটা খাটো বেঁটে গোছের। কোনোভাবেই লম্বা না। সে একহাত তুলে আকাশজুড়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের দিকে ইশারা করল— ‘ঐদিকে একনজর দেখো। জীবনে বৃষ্টিপাত তো কম দেখলাম না: ওপরে ওটা বর্ষার মেঘই।’

তারা দুজন চুপচাপ নীরবে হেঁটে চলল কিছুক্ষণ। বড় শহরের ভোঁতা লাল আলো তাদের পেছনে আঁকাবাঁকা রেখার ন্যায় জ্বলজ্বল করছিল। মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ায় বাইরে অল্পকিছু লোকই ঘোরাফেরা করছিল। আধমাইল সামনে তাদের শহর—তাদের গন্তব্য—রাতের আঁধারে অস্ফুট ফুটে উঠেছিল। কোনো বৈদ্যুতিক বাতিও জ্বলছিল না তার গলিঘুঁজিগুলিতে। সমস্ত দুর্ভাগ্যজনক কাঠামোই ঐ দুজন মানুষের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল নিখুঁতভাবে। ‘তুমি তো খোদা নও,’ শেষমেশ সুল মুখ খুলল। ‘বৃষ্টির কথা এতোটা নিশ্চয়তার সঙ্গে তুমি বলতে পার না।’

সুল পাকা সন্ত্রাসী ছিল। শেষবার সে বিচারকের সামনে তার জীবন-জীবিকা যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই নিহিত এ কথা বলে জেলখানায় আরও অতিরিক্ত কিছুদিন আপ্যায়িত হবার বন্দোবস্ত করে। ‘তোমার মতো চরিত্রদের থেকে সমাজকে রক্ষা করা প্রয়োজন’— কোর্টরুমের নীরবতা ভেঙে একরোখা বিচারকের উচ্চারিত এই শব্দগুলি এখনও তার কানে ভাসে। সুল কাঠগড়ায় টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চেহারায় ছিল না কোনো লজ্জাবোধ, কোনো তুষ্টি; আগে বহুবার এসব কথাই সে শুনেছে। ‘তুমি এবং তোমার মতো মানুষরা সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ, এবং আইন অনুযায়ী কোর্ট অবশ্যই নিশ্চিত করবে তুমি যেন তোমার প্রকৃত সাজা পাও।’ বিচারক সুলের দিকে দীর্ঘ শীতল এক শরের ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সুলও একইরকম নিরাসক্তি সহকারে তাকিয়ে থাকে বিচারকের দিকে। এইরকম আরও অসংখ্য বিচারকের চোখে চোখ রেখে তার আগেও কথা বলতে হয়েছে, কাজেই সে সহজে ভড়কে যায় না। তাছাড়া সে এক খোদাতায়ালা ছাড়া আর কাউকে, কোনোকিছুকেই ডরায় না। বিচারক তার আইনের থুতনি সামনে এগিয়ে আনে। ‘অপরাধ কেবল হতাশা, শাস্তি, আর কষ্ট ডেকে আনে, কখনও কি একটু বিরতি নিয়ে এ ব্যাপারে খানিকক্ষণ চিন্তা করতে পার না? দেখতে তো তোমাকে বেশ শক্তপোক্ত গড়নেরই লাগে। কেন সৎপথে কিছু উপার্জন করে পেট চালাবার বন্দোবস্ত কর না?’ জবাবে সুল তার চওড়া কাঁধ ঝাঁকি দেয়। ‘যে কাজ জানি, তার ওপরে নির্ভর করেই পেট চালাই’ সে বলে। ‘তা-ই আমার বেছে নেয়া পথ।’ বিচারক হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবারও সামনে ঝুঁকে বসেন, ‘চুরি, ছিনতাই—কাজগুলো যে অপরাধ, তা কি তোমার বিবেকে ধরা পড়ে না?’ জবাবে সুল আবারও কাঁধ ঝাঁকায়, ‘যে পথে আমি উপার্জন করি, তা আমার কাছে যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক।’ বিচারক বিস্মিত হন। ‘তৃপ্তিদায়ক!’ গোটা হলঘরে ফিসফিস আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। বিচারক হাতুড়ি ঠুকে সবাইকে চুপ করিয়ে দেন। ‘আইন ভাঙা তোমার কাছে তৃপ্তিদায়ক?’ জবাবে সুল বলে, ‘আমার আর কোনো রাস্তা নেই। তাছাড়া আইন এক ঝামেলার জিনিস। সবসময় মাঝপথে বাগড়া দেয়।’। ‘নিয়মিত অ্যারেস্ট হওয়া আর চৌদ্দশিকের ভাত খাওয়া, জেলখানার নিয়মিত পাখি হয়ে বেশ সুখে আছ মনে হয়?’ ভ্রু কুঁচকে বিচারক বলেন। ‘প্রত্যেক কাজের নিজস্ব বিপদাপদ আছে’ সুল দার্শনিক জায়গা থেকে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে। জবাবে বিচারক তার মুখের ঘাম মুছেন। ‘সে যাক বাপ, আইন ভাঙার সক্ষমতা নেই তোমার। তুমি কেবল তা ভাঙার চেষ্টাই করতে পার। বদলে তুমি নিজেই ভেঙে চুর হতে থাকবে।’ সুল সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ‘এমন একটা প্রবাদ আছ’ কথার পিঠে কথা চালাবার ভঙ্গিতে সে বলে। ‘গাছের গুঁড়ি ধরে নাড়াবার চেষ্টা যে করে, আসলে সেই নড়ে।’ তারপর উৎসুক চোখে সে ভ্রূ কুঁচকে থাকা বিচারকের দিকে আবারও তাকায়। ‘আইনও তো অমন মোটা গুঁড়ির মতো কিছুই, তাই না ওস্তাদ?’ জবাবে বিচারক তাকে তিনমাসের কয়েদ খাটার সাজা দেয়। সুল আবারও কাঁধ ঝাঁকায়। ‘আল্লাহর ইচ্ছাই পূরণ হোক তবে…’

ক্ষুরধার সর্পিল জিহ্বার মতো বজ্রপাত মুহূর্তের জন্য আকাশকে আলোকিত করে তোলে। সুল ওপরে তাকায়। ‘দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চিত বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হবেই: এটা বলা ঠিক হবে না। তুমি সামান্য এক মরণশীল মানুষ। তুমি কেবল বলতে পারো: যদি খোদা চায়, তবেই বৃষ্টি হবে।’ সুল তার নিজের বিবেচনায় ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ধার্মিক এক মানুষ। তার ধর্মবিশ্বাস তাকে তকদিরের ব্যাপারে নিশ্চিতরূপে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার ব্যাপারে বাঁধা দেয়। খোদার প্রতি তার ভীতি ছিল প্রায় নিখুঁত। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—প্রত্যেক বান্দার রিজিকের বন্দোবস্ত খোদা তার বান্দার নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সে নিশ্চিত ছিল—খোদা কিছু লোককে দরকারের চেয়েও অনেক বেশী করে দেন, যাতে করে যাদের অল্প আছে, তারা তাদের থেকে কাচিয়ে কুচিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এটা অবশ্যই খোদার ইচ্ছা হতে পারে না যে কিছু পেট ভুখা পড়ে থাকবে, যেখানে কিছু পেট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পূরণ হয়ে থাকবে সবসময়।                         

ডোগো শব্দ করে নাক ঝাড়া দিল। শহরের সব বড় জেলখানাগুলিতে সে জেল খেটেছে। তার কাছে জেলখানাগুলি এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে বেড়ানোর জায়গার মতো হয়ে উঠেছে। সুলের মতো সেও কোনো মানুষকে ভয় পেত না; তবে তার সঙ্গীর মতো সে ধার্মিক ছিল না। ‘তুমি আর তোমার ধর্ম’ সে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘বড় উপকার করেছে ওটা তোমার।’ সুল জবাব দেয় না। ডোগো তার  অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সুল নিজের ধর্মের ব্যাপারে অতিরিক্ত অনুভূতিপ্রবণ, আর সে একবার মেজাজ হারালে ডোগোর মাথায় ধড়াম করে একটা বাড়ি মারার মাধ্যমে এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। তাদের এ সম্পর্ক ভালোবাসা, বন্ধুত্ব অথবা এরকম আরও কোনো মহৎ চিন্তাভাবনা প্রসূত—এরকম কোনো ধারণা এই দুজন মানুষ কখনোই একে অপরকে দেয়নি। যখনই তাদের জেল খাটার মাঝে বিরতি পড়ত তখনই তারা কেবল একত্রে কাজ করতে পারত। এক যৌথ প্রকল্প, যা কেবলই দুপক্ষের লাভের ওপরেই নির্ভরশীল তাতে এমন কোনো ঠাট্টার নিয়মকানুন থাকতে পারে না। ‘মহিলাটাকে আজ রাতে দেখেছ তুমি?’ ডোগো আলাপের বিষয় বদলে ফেলে, সুলের মেজাজ খারাপ করতে সে ভয় পাচ্ছিল জন্য নই, বরং তার মগজটাই ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে বেড়ায় সবসময়।

‘নাহ,’ সুল মুচড়ে ওঠে। ‘তারপর?’ সুল আর কিছু না বললে ডোগো নিজেই প্রশ্ন করে। ‘বেজন্মা!’ সুল নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে ওঠে। ‘কে, আমি?’ ডোগো আস্তে করে প্রশ্ন করে। ‘আমরা ঐ মাগীটাকে নিয়ে আলাপ করছিলাম,’ সুল আবারও জবাব দেয়।

তারা ছোট একটা খালের সামনে এসে হাজির হয়। সুল থেমে তার হাত-পা, ন্যাড়া মাথা ধুয়ে নেয়। ডোগো তীরেই বসে বসে পাথরে তার ছুরি ধার দিতে থাকে। ‘কই যাচ্ছি আমরা?’ সুল জবাব দেয়, ‘ইয়ন্দার গ্রামে’ শুনে ডোগো আবারও বলে, ‘ওখানেও একটা মাগী পুষছ তা জানতাম না’, ‘আমি কোনো মেয়েলোকের কাছে যাচ্ছি না’ সুল জবাব দেয়। ‘আমি যাচ্ছি খুদকুঁড়ো কুড়োতে, খোদা যদি রহম করেন, তো…’

‘অর্থাৎ চুরি করতে?’ ডোগো তার কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বের করে।

‘হ্যাঁ’ সুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার হাত তাক করে ডোগোর দিকে: ‘তুমি একটা বাটপাড়…একটা খানকির ছেলেও।’ জবাবে ডোগো চুপচাপ নিজের ছুরি ধার দিতে দিতে মাথা নাড়ে। ‘মাঝরাতে পানির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত পা ধোয়া, তোমার ধর্মের অংশ?’ সুল পানির স্রোতের ওপারে গিয়ে না ওঠার আগে জবাব দেয় না। ‘যেখানেই পানি পাও, হাতমুখ ধুয়ে নাও; আরেকটা পানির উৎসের দেখা সামনে মিলবে কি মিলবে না, তা পুরোপুরি খোদার হাতে। সে লাফিয়ে ওপরে উঠতেই ডোগো তার পিছু পিছু এগোতে থাকে। ‘মেয়েটাকে বেজন্মা বললে কেন তুমি?’ ডোগো প্রশ্ন করে। ‘কারণ সে ওটাই’, ‘কেন?’, ‘সে আমাকে বলেছে যে মাত্র পনেরো শিলিং-এর বিনিময়ে সেই কোট আর কালো রঙের ব্যাগটা বিক্রি করে দিয়েছে।’ সে নিচে সঙ্গীর দিকে তাকায়। ‘আমার মনে হয় আমি গিয়ে হাজির হওয়ার আগে তুমি নিজেই তার কাছে গিয়েছ, গিয়ে শিখিয়ে এসেছ কি বলতে হবে?’ জবাবে ডোগো প্রতিবাদ করে বলে, ‘একসপ্তাহ হয়ে গেছে আমি ওকে চোখের দেখাও দেখিনি। কোটটা পুরোনো। পনেরো শিলিং তো ওটার জন্য ঠিকই আছে। সে যা করেছে, ভালোই করেছে।’ সুল কিন্তু ডোগোর কথা বিশ্বাস করল না। সে বলল, ‘না, ঠিক আছে তোমার কথা। আমিও একই রকম ভাবতাম, যদি আমি বিক্রির টাকার অংশ ওকে পৌঁছে দিতাম।’

জবাবে ডোগো কিছু বলল না। সুল সবসময়ই তাকে সন্দেহের চোখে দেখত, এবং সে ইচ্ছে করেই সেই অভিযোগ বারবার করে করত। কখনো কখনো তাদের একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ছিল ভিত্তিহীন, কখনো কখনো সঠিক। ডোগো কাঁধ নাড়ল। ‘তুমি কি নিয়ে আলাপ করছ আমি বুঝতে পারছি না’ জবাবে সুল শুকনো কণ্ঠে বলে, ‘আমি তা আশাও করি না’ ডোগো বলে, ‘আমার কেবল নিজের ভাগের টাকাটা দরকার’ শুনে সুল বলে ওঠে, ‘অর্থাৎ তোমার দ্বিতীয় ভাগের টাকা। দুটোই পাবে তুমি খানকির ছেলে বাটপাড় কোথাকার। সেই ঘেউ ঘেউ করতে থাকা শয়তান বেটিটাকেও।’ সুল একটু বিরতি নিয়ে বলে, ‘মাগী আমার রানের ওপর ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল’ ডোগো আপন মনে খিক খিক করে হাসে। ‘ওহ, তাই তো এতদিন ধরে ভাবি, তোমার ঊরুটা অমন উঁচু হয়ে ফুলে আছে কেন। ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল, তাই না? অদ্ভুত না ব্যাপারটা?’ সুল উত্তরে তীক্ষ্ণ চোখে ডোগোর দিকে তাকায়। ‘কেন? অদ্ভুত হবে কেন?’ ‘না, এই যে ধর, নিজের বখরার টাকাটা চাইতে গিয়ে ছুরির কোপ খেলে।’ ‘আমি চাইতে গিয়েছি টাকা? আমি চাইনি ঐ বেটির কাছে কিছু। ওর মতো চরিত্রের একটা মানুষের কাছে দুনিয়ার কিছু চেয়ে কোনো লাভ নেই।’, ‘তাই নাকি?’ ডোগো অনেকটা ফোঁড়ন কাটে। ‘আমি তো সবসময়ই ভেবেছি, তোমার কেবল চাওয়ার অপেক্ষা। সত্যি, কোটটা তোমার ছিল না। কিন্তু তুমি ওটা ওকে বিক্রি করতে বলেছিলে। বেটি সে এমনিতেও এক চুন্নি, ওর জানা থাকা উচিত ছিল এই বিক্রির মালে তোমারও ভাগ আছে।’ সুল চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কেবল মাত্র এক গাছবলদের কাছেই একটা কোট আর একটা ব্যাগের দাম পনেরো শিলিং হতে পারে।’ ডোগো আবারও খিক খিক করে হেসে ওঠে, ‘তুমি নিজে বলদ নও? ব্যাপারটা নিয়ে পরে কি করলে?’ ‘মেরে হারামজাদির হাড্ডি গুঁড়িয়ে দিয়েছি।’ সুল দাঁতে দাঁত ঘসে বলে। ‘তা অবশ্য ঠিকই করেছ।’ ডোগো বলে। ‘তবে একমাত্র সমস্যা হলো, তুমি ওকে যা দিয়েছ, ও তার চেয়ে বেশী তোমার ঠ্যাংয়ে বসিয়ে দিয়েছে।’ সুল গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘আমার এ দগদগে ঘা কোনো রসিকতার জিনিস নয়।’ ‘আরে রসিকতা করছে কে?’ ডোগো বলে। ‘আমার দিনে আমিও ছুরির কোপ খেয়েছি। রাতের বেলা ছুরি একখানা ঝুলিয়ে ঘুরবে, আর দু’চারবার তার খোঁচা খাবে না, তা তো হবে না। এটাকে আমরা আমাদের পেশাগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।’ ‘নিশ্চয়ই,’ সুল বলে। ‘কিন্তু এতে করে আমার ঘা শুকাবে না।’ ‘না, কিন্তু হাসপাতাল তা নিশ্চয়ই পারবে।’ ডোগো বলে। ‘তা জানি। তবে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার আগে তারা হাজারটা প্রশ্ন করে।’

তারা গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করছিল ক্রমশ। তাদের সম্মুখের প্রশস্ত রাস্তা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়ে মিলেছিল বিভিন্ন ঘরের সাথে। সুল একটু বিরতি নিয়ে, তারই একটা পথ ধরে হাঁটা শুরু করে। দু’পাশে নজর বুলিয়ে তারা নিঃশব্দে হেঁটে চলে। জনাকীর্ণ সেসব মাটির ঘরগুলোর একটাতেও আলো জ্বলছিল না। প্রতিটা ঘরের জানালা ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল, সম্ভবত আগতপ্রায় ঝড় থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। পুবাকাশ থেকে প্রলম্বিত এক বজ্রপাতের গুড়গুড় আওয়াজ ভেসে আসে। তাদের দেখে হতচকিত হয়ে যাওয়া একদল ছাগল আর ভেড়ার পাল ছাড়া, গাঁয়ের সে রাস্তা তাদের দুজনের দখলেই ছিল। প্রতিবার সুল কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে তারা দুজনেই বাড়ির চারপাশ সতর্ক চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সুল তার সঙ্গীর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে সে যখন ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, কেবল তখনই সুল সামনে এগোয়।

এভাবে প্রায় সোয়া একঘণ্টা হাঁটার পর আকাশে এক চোখধাঁধানো বজ্রপাতের আলো তাদের দু’জনকে প্রায় অন্ধ করে দেয়। তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় লাগে না। ‘দ্রুত করতে হবে ভাই,’ ডোগো ফিসফিস করে বলে। ‘ঝড় চলে এলো বলে।’ উত্তরে সুল কিছু বলে না। একটু সামনেই ভাঙাচোরা একটি বাড়ি ফুটে উঠলে তারা দুজন হেঁটে ওদিকে রওনা হয়। বাড়ির অবস্থা দেখে তারা হতাশ হয় না। অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে, বাড়ির বাইরের চেহারা দেখে তার ভেতরে কি আছে, বেশিরভাগ সময়ই তা বোঝা যায় না। নোংরা গর্তের মাঝেও কখনো কখনো রাজভাণ্ডার লুকিয়ে থাকে। ডোগো সুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। সুল বলে— ‘তুমি বাইরেই থাকো, ঘুমিয়ে পড়ো না।’ একটা বন্ধ জানালার দিকে সে ইশারা করে, ‘চাইলে ওটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পার।’

ডোগো সেদিকে সরে গেল। সুল ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাড়ির কাঠের দরজা নিয়ে। সুলের কাজ ছিল এতোটাই নিখুঁত যে, ডোগোর তীক্ষ্ণ সজাগ কানেও তার কাজকর্মের কোনো আওয়াজ এসে ধরা দিল না। সে বলতেও পারল না যে সুল কখন সে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে। তার জন্য নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে তার মনে হচ্ছিল, যেন কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে, যদিও ঘড়ির কাঁটায় তখন হয়ত অতিবাহিত হয়েছে কয়েক মিনিট। হঠাৎ সে টের পেলো, জানালার তার দিকের কপাট আস্তে করে খুলে যাচ্ছে। সে একদম জমে মিশে দাঁড়িয়ে গেল দেয়াল ঘেঁষে। জানালা দিয়ে অবশ্য বেরিয়ে এলো সুলের পেশিবহুল হাত, তাতে এক বড়সড় ‘গৌড’ ফল আঁকড়ে ধরা। ডোগো ফলটা ধরতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল তার ওজনে। তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। এখানে মানুষজন এই ফলটাকে টাকা রাখবার ব্যাংকের চেয়েও বেশি ভরসা করে। ‘খালের দিকে’ সুল খোলা জানালা দিয়ে হিসহিস করে বলে। ডোগো বুঝতে পারে। ভারী ফলটা মাথার ওপর চাপিয়ে সে খালের দিকে ছোটা শুরু করে। সুল নিঃসন্দেহে বাড়ি থেকে বের হয়ে খালের দিকে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে বের করতে পারবে।

ফলটাকে সে যত্নের সাথে খালপাড়ে রেখে, তার আঁকাবাঁকা ছিলকা ছিলতে আরম্ভ করে। যদি এর ভেতর দামি কিছু থেকে থাকে, সে ভাবে, তার আর সুলের তা সমান সমান ভাগ করাই লাগবে, এমনটা না। তাছাড়া সুল নিজেই যে এর ভেতর থেকে কিছু বের করে পকেটে ঢোকায়নি আগেভাগে, তা সে কীভাবে নিশ্চিত হয়? সে তার ডান হাত ফলটার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া মাত্রই অনুভব করল, কেউ তার কবজিতে ভয়াবহ ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। সে লাফিয়ে উঠে হাত বের করতে করতেই তার মুখ দিয়ে গোঙ্গানোর তীক্ষ্ণ আওয়াজ বেরিয়ে এলো। নিজের কবজির দিকে মনোযোগ সহকারে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে অভিশাপ দিতে আরম্ভ করল। খোদার আসমানের নিচে আর জমিনের ওপর যা কিছু আছে, তার সবকিছুকেই, তার জানা দুটি ভাষায় মন খুলে গালি দিল যতক্ষণ পারে। গালি দিতে দিতেই সে হাতের কবজি চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল। তখনি তার কানে ভেসে এলো সুলের এগিয়ে আসার শব্দ, ফলে সে চুপ মেরে গেল। ছুলে আনা চামড়াটা পুনরায় ফলের গায়ে সেঁটে দিয়ে সে চুপচাপ হয়ে রইল। ‘ঝামেলা হয়েছে কোনো?’ সুল সামনে এসে দাঁড়ালে প্রশ্ন করল সে। ‘একদম না,’ সুল উত্তর দিল। তারপর দু’জনে মিলে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইল ফলটাকে ঘিরে। ডোগো সুলের নজর এড়িয়ে নিজের ডান হাতের কবজি বাম হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। ‘খুলেছ নাকি তুমি এটা?’ সুল প্রশ্ন করে। ‘কে? আমি? আরে নাহ!’ ডোগো জবাব দিল। সুল যে তাকে বিশ্বাস করেনি এটা সে বুঝতে পারছিল। ‘এটা এত ভারী কেন?’ ডোগো আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলে সুল জবাব দিল, ‘দেখা যাক,’

সুল চামড়া ছাড়িয়ে ফলের খুলে থাকা মুখে হাত ঢুকিয়ে দেয়া মাত্র সেউ তার হাতের কবজিতে ধারালো কিছুর কোপ খেয়ে ছিটকে গিয়ে হাত বের করে আনল ফলের ভেতর থেকে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে একই সঙ্গে। ডোগো নিজেও দাঁড়িয়ে পড়ল, এবং প্রথমবারের মতো সুল খেয়াল করল, ডোগো তার হাতের কবজি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, একে অপরের দিকে তাকিয়ে। ‘যেমন তুমি সবসময় বল, সবকিছুই আধা-আধি ভাগাভাগি হওয়া উচিত।’ ডোগো বলল। আস্তে, প্রায় শোনা যায় না এমন উচ্চারণে সুল কথা বলা আরম্ভ করল। যত গালি তার জানা আছে, তার সবগুলোই সে প্রয়োগ করল ডোগোর ওপরে। অপর দিকে ডোগোও জবাব দিচ্ছিল সমানে সমানে। তারা দুজনেই, নিজ নিজ গালির ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেলে, অবশেষে ক্ষান্ত দিল। ‘আমি বাড়ি যাচ্ছি,’ ডোগো বলল। ‘দাঁড়াও!’ সুল বলল। তার অক্ষত হাতটা দিয়ে সে নিজের পকেট তোলপাড় করে একখানা দেশলাইয়ের বাক্স বের করল। খুবই কষ্টে সে একটা কাঠি ধরিয়ে তা ফলের খোলা মুখের কাছে নিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ‘এটার দরকার নেই,’ সে বলল। ‘কেন?’ জানতে চাইল ডোগো। ‘কেননা, এর ভেতরে একটা রাগী রাজগোখরো সাপ বসে আছে।’ সুল জবাব দেয়। প্রচণ্ড বেদনা ধীরে ধীরে তার হাতের কবজি থেকে উঠে এসে সারা হাতকে অবশ করে দিচ্ছিল। সে বসে পরে। ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, কেন আমি বাড়ি যাচ্ছি না,’ ডোগো বলে। সুল জবাব দেয়, ‘তুমি এটা শোনোনি যে, যাকে গোখরো সাপে কাটে, সে গোখরোর পায়ের ওপরেই মারা যায়? ওর বিষ এতোটাই ভালো: তোমার মতো শুয়রের বাচ্চাদের মরার জন্য যথেষ্ট। তুমি কখনোই বাড়ি পৌঁছাতে পারবে না। বরং এখানেই বসে মরণের অপেক্ষা কর।’ ডোগো তার কথায় সম্মত না হলেও, ভয়াবহ যন্ত্রণা তাকে বসে পড়তে বাধ্য করল।

তারা দুজনেই কয়েক মিনিটের জন্য চুপচাপ রইল, যখন আকাশ জুড়ে বজ্রপাত খেলা করে বেড়াতে লাগল। শেষমেশ ডোগো বলল, ‘মজার ব্যাপার এই যে, তোমার শেষ বদমাশি হল এক সাপুড়ের ফল চুরি।’, ‘তবে আমার মতে এটার ভেতরে একটা কোবরা থাকার ব্যাপারটা আরও হাস্যকর, তাই না?’ সুল বলে। ডোগো কাতরে ওঠে। ‘আমার তো মনে হয় রাত শেষ হবার আগে আরও হাস্যকর সব ঘটনা ঘটবে। ‘আহ!’ সুল ব্যথায় বাঁকা হয়ে যায়। ‘কিছু নির্ঝঞ্ঝাট মৃত্যু, উদাহরণত।’ ডোগো উঠে দাঁড়ায়, ‘মাদারচোদ সাপটাকে মারা যাক,’ সে উঠে দাঁড়িয়ে খালের আশপাশ থেকে একটু করো পাথর খোঁজা আরম্ভ করে, কিন্তু পাড়ে না। ‘ধুত্তোর,’ পিঠের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সে বলে। ‘এগুলোর আর কোনো অর্থ নেই।’

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ‘কিন্তু তাই বলে ভিজতে ভিজতে মরব?’ ডোগো ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে। ‘এখান থেকে যদি সোজা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়, তবে ভেজা অবস্থায় হাজির হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’ সুল বলে। দাঁতে দাঁত চেপে ডোগো উঠে দাঁড়ায়। তার ভালো হাতে ছুরিখানা পাকড়ানো। চোখ বন্ধ করে সে সবটুকু শক্তি দিয়ে ফলটার ভেতর ছুরিটা ঢুকিয়ে দেয়। সরীসৃপটার কোঁকড়ানো শরীরে একের পর এক কোপ বসাতে বসাতে সে বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর যখন সে তার আগের জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে ফেরত আসে, তার নাক থেকে তখন বাঁশির মতো আওয়াজ বের হচ্ছিল; হাতের ক্ষততে ততক্ষণে পচন ধরে গিয়েছিল; তবে সাপটা মরে গিয়েছিল ততক্ষণে। ‘শালা শেষবারের মতো খেলা দেখিয়ে মরল।’ সাপটাকে উদ্দেশ্য করে বলল সুল। জবাবে ডোগো কিছু বলল না।

আরও কিছু সময় নীরবতার গহ্বরে হারিয়ে গেল। সাপের বিষ দুজনকেই নিশ্চিত মৃত্যুর থাবায় আঁকড়ে ধরেছিল, বিশেষ করে সুলকে, যে তার ক্রমাগত গোঙানো থামাতে পারছিল না কোনোভাবেই। ‘এভাবে মরছ তুমি, কি পোড়া কপাল তোমার,’ ডোগো বলে। তার চৈতন্যও ততক্ষণে প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। ‘মোটের ওপর খারাপ হয়নি ব্যাপারটা, চোরের বাচ্চা চোর!’ সুল চিৎকার করে। ‘আমি চোখের জলে ডুবে আছি তোমার জন্য শালা,’ অসম্ভব কষ্টে কাৎরাতে কাৎরাতে বলে ডোগো। ‘এখানেই সম্ভবত আমাদের পুরোনো পথের সমাপ্তি। কিন্তু তোমার জানা থাকা উচিত ছিল, এটা কোথাও না কোথাও গিয়ে থামতোই, খানকির ছেলে!’ সে বড় একটা শ্বাস ত্যাগ করে। ‘আমার সকালে তাহলে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া লাগত না,’ ঊরুর ক্ষতের ওপর কম্পিত হাত বোলাতে বোলাতে সে তোতলায়। ‘আহ’ সে হাল ছেড়ে দেয়ার মতো করে শ্বাস ত্যাগ করে। ‘আল্লাহর ইচ্ছাই পূরণ হোক তবে।’ বৃষ্টির গতি আরও বেড়ে যায়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত