Homeদেশের গণমাধ্যমেওদুন বালোগুনের ‘শিক্ষানবিশ’

ওদুন বালোগুনের ‘শিক্ষানবিশ’


ওদুন বালোগুন নাইজেরিয়ার বেনিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল আফ্রিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতি। যদিও তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তিনি আফ্রিকান সাহিত্যের গবেষক এবং বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

স্রেফ একটা অতীত থাকার কারণে শিক্ষানবিশির নিগ্রহ থেকে বেঁচে গিয়েছিল ওগুনমোলা। এমন এক অতীত, যার শেকড় বিস্তৃত ছিল ওবা’র আমল অবধি। ওবা, তার প্রপিতামহ। স্বনামধন্য ওবা। প্রাজ্ঞ শাসক।

ওগুনমোলার স্কুলে যাবার সুযোগ ছিল, কিন্তু সে যায়নি। সে তার পিতামহের পরিণতি দেখেছিল, যা তার এই অবস্থানকে চিরস্থায়ী করেছে।

সেইসময় সে নিছকই বাচ্চা ছিল। তার দাদামশাই তখন তার গৌরবোজ্জ্বল শাসনকালের শিখরে ছিলেন। জীবন বয়ে যাচ্ছিল অর্থপূর্ণভাবে। ঠিক যেমনটি ছিল তার বিখ্যাত বাবা ওবা’র আমলেও। তিনি তার প্রজাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উপভোগ করছিলেন। শান্তি ও স্থিতাবস্থা ছিল সর্বত্র। ছিল সম্প্রীতি ও সন্তুষ্টির সহাবস্থান…

তারপর আচমকা তারা এলো। এলো বিনা আমন্ত্রণে। যেন সেটুকুই যথেষ্ট ছিল না, তারা বলে কিনা তার দাদা নাকি শাসন করতে জানতেন না। তার দাদা! বিখ্যাত ওবা’র সন্তান! অভাব ও ঐশ্বর্য, শান্তি ও সংঘাত, স্বাস্থ্য ও ব্যাধির মধ্যেও যার শাসন ছিল কিংবদন্তির মতো!

এবং সেটাও সব নয়। জীবন, তারা দাবি করে, যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছিল না মোটেও। সবকিছু তাই ঢেলে সাজাতে হবে। একটা নতুন আরম্ভের প্রয়োজন।

এবং বস্তুতই আর দেরি না করে তারা সংস্কার শুরু করে দেয়। অমানবিক গতি ও তাড়াহুড়োর সঙ্গে। ওগুনমোলা, একটা বাচ্চা মাত্র, এর সবই দেখে। সে তাতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে দাদার অকালপ্রয়াণের কারণ বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। সে এটা বুঝতে পেরে ভীত হয়ে পড়ে যে, দাদার পরে তার বাবা আর রাজা হতে পারবে না। তার নামকরা দাদার শাসন আর কেউই চালিয়ে যেতে পারবে না। তার নিজের মধ্যেও কোনো ভান ছিল না…

এটা সত্ত্বেও তারা চেয়েছিল সে স্কুলে যাক! সেসব পরিবর্তনের ওপর তার সম্মতির ছাপ দেওয়ার জন্য, এবং তাকে দিয়ে এটা বলাতে যে, সেগুলো সব ঈশ্বরপ্রদত্ত ও সঠিক ছিল। সে, ওগুনমোলা, ন্যায়পরায়ণ জ্ঞানী শাসক ওবা’র পৌত্র!

না, না, কক্ষনো না। তার রাজরক্ত বিদ্রোহ করে এক নকল দেবতার অগৌরবের কাজ ও কর্তৃত্বেও প্রতি নত হবার বিরুদ্ধে। সে, একটা শিশুমাত্র।

কিন্তু তাকে কিছু একটা করতেই হত। তার তো জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। কী আসে যায়, যদি সময়টাই এমন হয়? এটাই কি তার জীবনের উদ্দেশ্য নয়? এরকম এক জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলা?

ওগুনমোলা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। সে একজন ওস্তাদ কামার হবার সিদ্ধান্ত নেয়। তার শিক্ষানবিশির বছরগুলোর সূত্রপাত হয় অতঃপর। জীবন ক্রমে অর্থময় হয়ে উঠবে। সে ভাবে।

কিন্তু সে ভুল ভেবেছিল। সত্যি বলতে কি, ঠিক তখনই তার সমস্যার শুরু হয়েছিল। ওমাতাইয়ের কাছ থেকে সে কাজ শিখছে, বছরখানেকও হয়নি, একদিন তিনি, তার ওস্তাদ, তাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলেন: “ওগুনমোলা”, তিনি তার ভদ্র, বিনয়ী গলায় বলতে শুরু করেন, “তুমি জানো আমি তোমাকে ছেলের মতো ভালোবাসি, এবং একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে তোমার প্রতি আমার দারুণ শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি জানি তুমি আমার নাম আরও উজ্জ্বল করবে। আর সেজন্যই সম্প্রতি তোমার কাজের যে ধরন দেখছি, তাতে আমি ব্যথিত বোধ করি।”

ওগুনমোলা তার ওস্তাদকে ভালোবাসত ও শ্রদ্ধা করত। ফলে গভীর উদ্বেগ নিয়ে সে তার কথা শোনে। সে বলে: “আমি কি আপনার কষ্টের কারণ জানতে পারি? আমি তাহলে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব সেটা দূর করতে।” আবেগে তার গলা ধরে আসে তখন।

“আমি যখন তোমার বানানো দা, কোদাল, ছুরি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখি”, ওস্তাদ বলে চলেন, “তারা তখন কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের আভাস দেয় না, তাদেরকে আকারহীন বলে মনে হয়। যত সূক্ষ্মভাবেই আমি তাদের দেখি না কেন, সেখানে আমার দেওয়া শিক্ষার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাই না আমি। আমি তোমাকে বারবার বলেছি, একটা কোদাল বানানোর সময় তোমার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সেটাকে একইসঙ্গে কতটা কাজের ও কমদামি করা যায়। একটা সুন্দর কোদালের কী অর্থ আছে, যদি সেটা সবার, সবার কেনার সামর্থ্য না থাকে? এখন যেভাবে চলছে তাতে করে লোকেরা শিগগিরই বলতে শুরু করবে, তুমি ওমোতোলার শিষ্য।” এভাবেই গভীর হতাশার সঙ্গে ওস্তাদজি তার কথা বলা শেষ করেন।

ওমোতাইয়ে যখন তার কোনো ছাত্রের কাজকে ওমোতোলার কারখানার কোনো কাজের সঙ্গে তুলনা করেন, তখন সেটা তার কাছে কাজ-শেখা সেই ছাত্রের কঠোরতম সমালোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। ওগুনমোলা সেটা জানত বলে বিচলিত বোধ করে। সে তার ওস্তাদের কথার সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়, কিন্তু একইসঙ্গে সে তার মধ্যে কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করে। সেটা একেবারেই তার নিজস্ব, যা সে দা বানানোর কাজে লাগাতে পারে, যাতে করে সেটি আরও কার্যকর, সস্তা, সহজলভ্য ও সুন্দর হয়ে ওঠে। এই কারণে সে নিরন্তর নিরীক্ষা করে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে সে তার গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছায়। তবুও যতই সে তার গন্তব্যের নিকটবর্তী হয়, ততই তার বানানো দাগুলো তার ওস্তাদের তৈরি দা-এর চেয়ে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। সে এটা লক্ষ করে এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যদিও সে ভাবে তার ওস্তাদ এই তফাৎটা হয়ত লক্ষ করবেন না। কিন্তু হায়…

“ওস্তাদজি”, ওগুনমোলা কৈফিয়তের সুরে বলে—“আপনি জানেন আমি ওমোতোলাকে নকল করতে চাই না। আমি কেবল আমার নিজের মতো করে দা বানাতে চাইছি।”

“তুমি বাজে কথা বলছ, পুত্র আমার। এটা পুরোনো গল্প। এটাই সবাই বলে, যখন তারা আমার বিরুদ্ধে যেতে চায়। কিন্তু তাই বলে তুমিও তা করবে! তুমি, যাকে আমি এতটা ভালোবাসি! তুমি, যে আমার…”। ওস্তাদের গলা বুজে আসে আবেগে এবং তিনি আর কথা বলতে পারেন না। অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই তিনি নিজেকে সামলে নেন এবং কঠোর, আপসহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, “মনে রেখো, তুমি যদি আমার শত্রু হতে চাও, তাহলে ভুলে যেয়ো না, একজন শত্রু কিন্তু শত্রুই।”

ওগুনমোলা ভয় পেয়ে যায়, তবু সে কোনোমতে বলে—“আমি আপনার শত্রু নই, ওস্তাদজি।”

তাকে বিশ্বাস করা হয় না। ওস্তাদের কারখানায় তার জীবন ফলত কঠিন হয়ে ওঠে ক্রমশ। সে তার এই উদ্যমকে খুন করতে চায়। তবুও যা-কিছু সে বানায় তাতেই তার ওস্তাদ নয়, তার নিজের একটা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। ওস্তাদের চোখে তার এই স্বাতন্ত্র্যটুকু ওমোতোলার কারখানার তৈরি পণ্যসমূহের মতোই প্রতীয়মান হতে থাকে ক্রমে। ছাত্রের প্রতি তার ভালোবাসা ক্রমশ বিরাগে পরিণত হয় এবং দ্রুতই তা শত্রুতায় পর্যবসিত হয়। কৈফিয়তে কোনো কাজ হয় না। তাতে কেবল অবস্থার অবনতি হয়।

এই কঠিন সময়টাতে নিষ্ঠুর বাস্তবতা থেকে বাঁচতে ওগুনমোলা অতীতের আশ্রয় নেবার কথা ভাবে। সে তাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারের গল্পগুলো মনে করতে থাকে, তার মা তাকে যেভাবে তা বলতেন। এতে করে মনে হত, সে বুঝি নিজেই তার সাক্ষী। প্রতিরাত্রে সে তার প্রপিতামহ ওবা’র স্বপ্ন দেখত, সেই প্রাজ্ঞ শাসকের কথা। সে ঘুমের মধ্যেই তার সর্বশেষ নায়কোচিত কাজের কথা মনে করে আনন্দে শিহরিতো হতো।

“প্লেগটা এসেছিল আচমকা”, তার মা তাকে বলেন। “ওবা তখন দেশ চালাচ্ছিলেন। তখন কোনো অভাব অনটন ছিল না। লোকেরা সুখী ছিল। জীবন সহজ কিন্তু অর্থবহ ছিল। তারপর অকস্মাৎ এই প্লেগের আক্রমণ!

“তার ফলাফল ছিল ত্বরিত ও ভয়ংকর। শয়ে শয়ে লোক মারা যাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল দেশের সব মানুষই নির্মূল হয়ে যাবে। আর তখনই জ্ঞানীরা দেবতার সঙ্গে শলাপরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

“দেশের দেবতা অপমানিত হয়েছেন। একটা অস্বাভাবিক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাই। আমাদেরও একজনকে স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিতে হবে, কোনোপ্রকার জোরজবরদস্তি ছাড়া। একেবারে স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই করতে হবে তা।

“একমাত্র প্রণোদনা হবে—দেশের মানুষের জন্য সেই ব্যক্তির ভালোবাসা। তা না হলে দেশের আত্মা শান্তি পাবেন না।” এটাই বলেন সকল দেবতা।

“অনেকদিন ধরে কেউ এগিয়ে আসে না। লোক মারা যেতে থাকে হাজারে হাজারে। ঠিক তখন একদিন খুব সকালবেলায়, ওবা, প্রজাদের প্রিয় ও প্রাজ্ঞ শাসক তার পরিবারের সদস্যদের তলব করেন। তিনি একে একে সবাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করেন এবং তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন।

কথাটা ছড়িয়ে যায় দাবানলের মতো। তাকে নিবৃত্ত করার চাপ বাড়তে থাকবে প্রতি মুহূর্তে। জনগণ আলাপ-আলোচনা করে একটা প্রতিনিধিদল পাঠায় তার কাছে। তারা গিয়ে রাজাকে বলে: “এটাই কি যথেষ্ট নয় যে, আমরা মুরগির বাচ্চার মতো মারা যাচ্ছি? আমাদেরকে কি এখন রাজাকেও হারাতে হবে? তাও আপনার মতো একজন রাজা! আপনাকে হারানোর আগে আমরা বরং সবাই মারা যাব।” এরকম আরও অনেক কথা হয়। কিন্তু ওবা তাতেও নিরস্ত হন না।

সেটা এক বিষণ্ন বিকেল ছিল। সবার বুকে কষ্ট। মুখে সবার ভয়ের চিহ্ন আঁকা। ওবা, গুণেমানে অনন্য, প্রাজ্ঞ শাসক, প্রশান্ত চিত্তে পাহাড়ের দিকে হেঁটে যান। প্রিয় রাজার শেষযাত্রার সঙ্গী, বিষণ্ন প্রজাদের মাঝে নিশ্ছিদ্র নীরবতা বিরাজ করছিল তখন। এই বিষাদময় নীরবতা মাঝেমধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল পথের দুপাশের নির্জন বাড়িসমূহের ভেতর থেকে ভেসে আসা বুকফাটা চিৎকারের শব্দে। শোকার্তরা তাদের মৃতদের জন্য শোক প্রকাশ করছিল। প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে মিছিলের কেউ না কেউ আচমকা স্থবির হয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা পড়ছিল, যারা কিনা একটু আগেও সপ্রাণ ও সচল ছিল। ঝোড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়া শুকনো ও মৃত বৃক্ষশাখাদের মতো। সবার বুকে ব্যথা। সবার মুখে ভয়।

ওবা দ্রুত পা চালান। দেখতে দেখতে তিনি খাদের কিনারে পৌঁছে যান। রাজা পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেবার সময় সবার মনে এক অব্যক্ত আশঙ্কা চেপে বসে। তিনি কোনো চিহ্ন না রেখেই গভীর খাদে তলিয়ে যান।

দেশের আত্মা শান্তি পায়। জীবন শুরু হয় নতুন করে। তোমার পিতামহ সিংহাসনে বসেন। তিনি তার বাবা, তোমার পিতামহ, দেশের গৌরব বিখ্যাত ওবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আবারও দেশ ভরে ওঠে ঐশ্বর্যে, লোকেরা প্রাচুর্য ও স্বস্তি উপভোগ করে, জীবন ছিল সহজ ও অর্থবহ।

“তারপর হঠাৎ আসে তারা। বিনা আমন্ত্রণে… তুমি তো গল্পের বাকিটা জানো, পুত্র আমার।” এভাবেই কথা শেষ করেন তার মা। তার কণ্ঠে বিষাদ।

তার মা মারা গেছেন সাত বছর আগে, কিন্তু এই গল্পের স্মৃতিচারণ তাকে অনুভব করায়, বুঝিবা এখনও জীবন্ত তিনি; যেনবা তিনি নিজেও সেই ছয় বছরের নিশ্চিন্ত বালকটিই আছেন। তিনি সুখী, জীবন একদা অর্থপূর্ণ ছিল, একদা সেখানে এমন একজন রাজা ছিলেন যিনি জানতেন কীভাবে শাসন করতে হয়, যেকোনো একদিন এমন একজন রাজা আবারও আসতে পারেন…

শিক্ষানবিশির কঠিন দিনগুলোতে এই ভাবনাগুলোই ছিল ওগুনমোলার মনের আরাম। ওমোতাইয়ে দ্রুতই তাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শুরু করেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তার ছাত্রকে চলে যেতে বলেন। শিক্ষা সমাপ্তির প্রত্যয়নপত্র ছাড়া ওগুনমোলা তার বিদ্যাচর্চা করতে পারত না। যদিও সে জানত যথেষ্ট জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তার, যার ওপর ভিত্তি করে সে নিজেই একজন ওস্তাদ হয়ে ওঠতে পারে। এভাবে একদিন সে নিজেকে নদীর ওপারে আবিষ্কার করে। ওমোতলার দরজার কড়া নাড়ারত অবস্থায়।

“এই যে দেখ কে এসেছে! আসো আসো ভেতরে আসো। আমি কি তোমাকে বলিনি তুমি আমার বাড়িতে স্বাগত? হ্যাঁ,…তা-ই! আমি একটুও অবাক হইনি। এটা কি সবাই জানে না যে, ওমোতাইয়ে একটা পাগল? এটা যে হয়েছে তাতে আমি খুশিই বরং। আমি সবসময়ই তোমার মতো একজন ছাত্রের স্বপ্ন দেখেছি। আমার সঙ্গে তোমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্যরকম হবে। তুমি যেকোনো ধরনের দা, কোদাল ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি বানাতে পারবে। একেবারে স্বাধীনভাবে। অবশ্য, কেইবা আর এমন দা বানাবে, যেটা একই সঙ্গে শক্ত ও সুন্দর নয়? লোকেরা জানে তারা গুণ কিনছে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার এর জন্য কিছু বেশি ব্যয় করতে দ্বিধা করবে না। তাহলে আর রাম, শ্যাম, যদু, মধুর কথা ভাবছ কেন? এর নিশ্চয়তাই বা কোথায় যে, তাদের একজন রাম আমাদের দা কিনে থাকলেও সেটা সে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারবে? তাই বলি, তুমি স্বাগত এখানে। এসো ভেতরে এসো।

এভাবেই ওগুনমোলাকে বরণ করেন ওমোতোলা, ওমোতাইয়ের জাতশত্রু, তার আগের ওস্তাদ। ওগুনমোলা তার এই সংবর্ধনার কারণ বুঝতে পারে, তবে সেটাও জানে যে, তাকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হায়, একবছর যেতে না যেতেই ওমোতোলা তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করেন।

“আমি তোমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছি, ওমোতোলা তোমার মাথায় যে জঞ্জাল ভরেছে সেগুলো দূর করার জন্য। মনে হচ্ছে, এ নিয়ে তোমার কোনো তাড়া নেই। হয়ত তুমি সেটা চাও-ও না…হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিকই বুঝতে পারি। তুমি যতটা ধারণা কর তার চেয়েও অনেক বেশি। সবাই বলে যে, ঠিক এই মুহূর্তেও তুমি আমার বিরুদ্ধাচরণ করছ। তবে এটা পুরোনো খেলা, বৎস আমার, আর তার উত্তরটাও বাইবেলের মতোই পুরোনো। তুমি দুজন প্রভুর দাসত্ব করতে পার না। আর তাই হয় তুমি আমার পক্ষে অথবা আমার বিরুদ্ধে। আর এখন সময় হয়েছে, তুমি তোমার অবস্থান পরিষ্কার করবে।

আবারও জীবন তেতো হয়ে ওঠে ওগুনমোলার কাছে। সে কী করবে? সে তার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছে স্কুলে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে, তবে সেটা করতে গিয়ে অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। আর সবই হয়েছে এই নিষ্ঠুর সময়ে অচেনা মানুষের অধিকার ও মর্যাদা হরণজনিত পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়ার জন্য।

গুজব রয়েছে, ওমোতাইয়ে এবং ওমোতোলা জমজ ভাই, একেবারে একইরকম দেখতে। দুজনই সমান লম্বা ও ক্রীড়াবিদের মতন দেখতে, স্বাস্থ্যবান ও ফুর্তিবাজ, সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী, মেধাবী ও পরিশ্রমী, ঠান্ডা মাথা ও কুশলী, দক্ষ ওস্তাদ দুজনই…

তাদের সাদৃশ্যের তালিকা আরও লম্বা হতে পারে। যদিও এই দুই জমজ ভাই-ই সবার আগে তা অস্বীকার করবে, কোনোপ্রকার সম্পর্কেও কথাও। আদমের সময় থেকেই তারা কেউ কাউকে চেনে না। তুমি কি ভূগোল পড়নি? তাহলে তুমি কীভাবে নদীর এপারে বাস করা একজনের সঙ্গে ওপারের আরেকজনকে গুলিয়ে ফেলতে পার? তুমি কি সময়ের চিহ্নও পড়তে পার না? তাহলে তুমি কেন যে-রাস্তাটি সামনে, ভবিষ্যতের দিকে গেছে, তাকে যেটি উল্টোমুখী অতীতের দিকে যায়, তা থেকে আলাদা করতে পার না?

এইসব তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ ছিল না।

ওগুনমোলা এর সবই শোনে কিন্তু ভেবে পায় না, কীভাবে সে তাদের বুঝাবে যে, কোনো পারিবারিক কলহের মধ্যস্থতাকারীর হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার; দুইভাইয়ের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে যাবার কোনো ইচ্ছাই তার নেই; যে, তার একমাত্র ইচ্ছা একজন কামারমিস্ত্রি হওয়া, একজন সাধারণ কামার, যে তার নিজের মতো করে দা বানাতে পারবে; আর সেই কাজটা যখন কঠিন হয়ে যাবে তখন ওবা’র স্বপ্ন দেখা, তার সেই প্রাজ্ঞ পিতামহ ওবা।

সেটা কি বেশি চাওয়া? ওগুনমোলা বলতে পারে না। সে কেবল জানে সেটা ছিল এক কঠিন সময় এবং সে চাইত, সে যেন বেঁচে থাকতে পারে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত