শহীদুল জহিরকে (১৯৫৩—২০০৮) জাদুবাস্তবতার দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করেন অনেক সাহিত্য সমালোচক। এতে শহীদুল জহির খণ্ডিত হয়ে পড়েন। শহীদুল জহির জাদুবাস্তবতার নয় বরং অতিবাস্তবতার লেখক। অতিবাস্তবতা হলো একটা দার্শনিক ধারণা যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যকার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়। শহীদুল জহির সমাজের বাস্তব রাজনৈতিক সংকটকে এমন একটি অবাস্তব আঙ্গিক ও ধারণা থেকে ব্যাখ্যা করেন যে শেষ পর্যন্ত সেটা অতিবাস্তবতার রূপ নেয়। এটি করতে গিয়ে তিনি সফলভাবে নানা কৌশল ব্যবহার করেছেন যার মধ্যে জাদুবাস্তবতা অন্যতম। আর এইভাবে তার রচনা হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে অনাবিষ্কৃত দ্বীপের মতো।
শহীদুল জহিরের রচনার আঙ্গিক নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমে যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো তার বাক্য নির্মাণ। তিনি ছোট ছোট বাক্যকে জুড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘ বাক্য নির্মাণ করতেন। গল্পের প্রেক্ষাপটকে জোরালো ও অতিবাস্তব করে তোলার জন্য এই ধরনের দীর্ঘ বাক্য অনেক বড় ভূমিকা রাখে। ‘আমাদের বকুল’ গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদটা এমন:
“গ্রামের লোকেরা তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় ছিল। সন্ধ্যার আগ দিয়ে আকালু সুহাসিনীতে ফেরে, সেই সময় গ্রামের যারা হেমন্তের বিস্তীর্ণ মাঠে নুয়ে থাকা ফসলের ওপর দিয়ে তাকায়, তারা তাকে বহুদূরে বৈকুণ্ঠপুরে গ্রাম পার হয়ে খোলা মাঠের কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে।”
আবার ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পে—
‘আমাদের মহল্লা, দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাস আমাদের মনে পড়ে; মহল্লায় গরম পড়তে শুরু করলে চৈত্র, বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসে তরমুজওয়ালারা তরমুজ নিয়ে আসে এবং আমরা তরমুজ খেতে শুরু করি, আমরা তখন তরমুজ সম্পর্কে সচেতন হই; আমরা লক্ষ করি যে, এই তরমুজওয়ালারা মহল্লার গলির সংকীর্ণ একটা জায়গায় মাটিতে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে, গোল গোল তরমুজের ছোট ছোট ঢিবি বানিয়ে বসে, তারা এই জায়গায় কেন বসে আমরা বুঝতে পারি না, ফলে এই জায়গায় এসে রিকশা, ঠেলাগাড়ি, গোরুগাড়ি, বেবিট্যাক্সি, কুকুর, বেড়াল, ছাগল এবং মানুষ একটা জট পাকিয়ে ফেলে; …’ এভাবে চলতে থাকে বাক্যটি। লেখক মনে করতেন মানুষের এই যে সমষ্টিগত জীবন তা অবিরাম। শুধু চরিত্রের মানুষগুলো বদলায়। তাই তাদের জীবনের আলেখ্য হবে চলমান। তিনি এমন দীর্ঘ বাক্য তৈরি করে জীবনের বহমানতাকে ধরতে চেয়েছেন।
শহীদুল জহির ’৪৭ পরবর্তী সময়ে পশ্চিম বাংলা আর পূর্ব বাংলার ভাষার যে সাধারণ রূপ তা থেকে বেরিয়ে স্থানিক একটা মান তৈরি করেছেন। তা শুধু তার সংলাপে নয় বর্ণনাতেও স্পষ্ট হয়। তিনি অনেক আঞ্চলিক শব্দকে তার বর্ণনায় অবলীলায় স্থান দিয়েছেন।
শহীদুল জহিরের চরিত্রগুলো কখনো একক নয় তারা একটি সামষ্টিক চরিত্র। মার্ক্সীয় সাহিত্যের এই প্রবণতা তার লেখায় ভীষণভাবে স্পষ্ট। তার গল্পের চরিত্রগুলো আমি বা সে নয়— আমরা বা তারা। যেমন ‘কাঁটা’ গল্পে— মহল্লার লোকেরা তখন এরকম আশা করতে থাকে যে, এ হয়ত অন্য কোনো সুবোধ, অন্য কোনো স্বপ্না, কিন্তু তাদের এই আশা নির্বাপিত হয়।’ এমন বাক্য প্রায় গল্পে খুঁজে পাওয়া যাবে। যারা শহীদুল জহিরের রচনায় ওয়েস্টার্ন সাহিত্যের আরোপিত প্রভাব খুঁজে পান তাদের যুক্তি খণ্ডনে একটা বড় অনুষঙ্গ হতে পারে এটি। ওয়েস্টার্ন সাহিত্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক কারণ তাদের জীবনবাস্তবতাটাই এমন। সেখানে পুঁজিবাদী সভ্যতার বিকাশের কারণে মানুষগুলো ভীষণভাবে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আমাদের সমাজ একেবারে ভিন্ন। এখানে আমাদের ভাবনা ও ভবিষ্যৎ একটা সামষ্টিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে।
শহীদুল জহির রাজনীতি সচেতন একজন লেখক। বার বার মুক্তিযুদ্ধ ফিরে এসেছে তার লেখায়। তবে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি থেকে উপস্থাপন করেন। সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তিনি পুরান ঢাকার পটভূমিতে সাজিয়েছে। তার ছোটগল্প ‘কাঁটা’, ‘মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা’, ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’-তে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ভাবনা স্পষ্ট। ‘কাঁটা’ গল্পে আমরা দেখি একটা হিন্দু পরিবারকে যাদের একটি কুয়োর মধ্যে ফেলে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশির দশকে দ্বিতীয় সামরিক শাসনের কালে ঐ নামের আরেকটি পরিবার ফিরে আসে। এবং গল্পটিতে একটি জাদুবাস্তবতার ইমেজ সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে আশির দশকে একটা অস্থির সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠার ইঙ্গিত লেখক এখানে দিয়েছেন। গল্পের একটি অংশ এমন—‘…তখনও পর্যন্ত মহল্লায় হয়ত সুবোধচন্দ্র আসে নাই, দেশ স্বাধীন হয় নাই এবং অযোধ্যার মসজিদও ভাঙা হয় নাই; কিন্তু তখন, একই সঙ্গে তারা সুবোধচন্দ্রের ক্রমাগতভাবে কুয়োর ভেতর পড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা মনে করতে পারে এবং তারা খুবই বিচলিত এবং গ্লানিবোধ করে এবং বিভ্রান্ত হয়।’
‘মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের কালে পুরান ঢাকার মানুষের এক হয়ে লড়াইয়ের প্রচেষ্টার কথা আছে। আব্দুল হালিমের মৃত্যুতে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ স্পষ্ট হয় গল্প জুড়ে।
‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্পে সেভাবে গল্পের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে এটিকে জাদুবাস্তবতার গল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে থাকেন। নকশালপন্থি রাজনীতির প্রতি লেখকের এক ধরনের পক্ষপাত স্পষ্ট হয় গল্পটিতে। ‘আব্দুল ওয়াহিদ সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে বিএ পাশের পর এমএ পড়তে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছর ঢাকায় এসে নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার পরও গ্রামে ওয়াহিদ ফিরে না আসায় লোকজনের মুখে ভিন্ন কাহিনির জন্ম হয়। এসবের মধ্য দিয়ে নকশালপন্থি কার্যকলাপের প্রভাব ফুটে ওঠে। ব্যাঙনাই নামক গ্রামের এক বাড়িতে ডাকাতিতে সম্পৃক্ত থাকায় ওয়াহিদের নকশালপন্থি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গ্রামবাসী জানতে পারে। লেখক শহীদুল জহির তৃতীয় বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। এই কারণে বাম রাজনীতির উপর তার এক ধরনের পক্ষপাত ছিল। তাই বলে তার রচনায় সেটি প্রকট হয়ে উঠেনি। কারণ তিনি সচেতনভাবেই বিশ্বাস করতেন দর্শন বা বক্তব্য প্রকট হলে রচনা দুর্বল হয়ে পড়ে।
শহীদুল জহির বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মার্কেজে আচ্ছন্ন ছিলেন। কিন্তু তিনি ঐতিহ্যকে ধারণ করে স্বকীয় হয়ে উঠতে বেশি সময় নেননি। এ ব্যাপারে তিনি প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন। আত্মমগ্ন এই লেখক সব সময় পাঠক ও লেখকের ভিড় এড়িয়ে চলতেন। তাই শহীদুল জহির তার লেখার মতো এখনো একজন অনাবিষ্কৃত রহস্য দ্বীপ।