বাঙালির প্রধান খাবারের মধ্যে মাছ অন্যতম। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’—প্রচলিত এই কথা বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের গভীরতা প্রকাশ করে। তবে শুধু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মাছ একটি জনপ্রিয় আমিষজাতীয় খাবার; বিশেষ করে সৌদি আরবের নাগরিকদের খাদ্যতালিকায় সামুদ্রিক মাছের বিশেষ কদর রয়েছে। হামুর, শোর, নাজেল, গামার, মিফা বা আরাবি ও বোলতি মাছ সৌদি নাগরিকদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
সৌদি আরবের বাণিজ্যিক শহর জেদ্দা। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশেল দেখা যায় সেই শহরে। এখানকার কেন্দ্রীয় মাছবাজারটি শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রতিদিন ভোরে শত শত জেলে এখানে তাঁদের ধরা তাজা সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করতে আসেন। বাজারের চারপাশে সারি সারি রঙিন মাছের দোকান, মাছ কাটার শব্দ, ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাক—সব মিলিয়ে এটি দারুণ জমজমাট।
জেদ্দার কেন্দ্রীয় মাছবাজার শুধু ব্যবসার জন্য নয়, এটি সৌদি আরবের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি বহন করে। এই বাজারের গুরুত্ব শুধু স্থানীয় অর্থনীতিতেই নয়, বরং এটি পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় জায়গা। অনেক পর্যটক এখানে আসেন সৌদি আরবের সামুদ্রিক খাবারের সংস্কৃতি এবং স্থানীয়দের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানার জন্য।
সৌদি ট্যুরিজম অথরিটির (এসটিএ) আমন্ত্রণে সৌদি আরব ভ্রমণের অংশ ছিল জেদ্দার এই কেন্দ্রীয় মাছবাজার। সৌদি সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে এই ভ্রমণের সুযোগ হয়। সফরের ব্যবস্থাপনায় ছিল স্থানীয় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘হামজা ক্যামেল ট্যুরস’ এবং আমাদের গাইড ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও ইমাদ এম কাশমিরি। তাঁর মাধ্যমে জেদ্দার কেন্দ্রীয় মাছবাজারের ইতিহাস, সৌদি অর্থনীতিতে এর অবদান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল।
সৌদি আরবের উপকূলে মাছ ধরা এবং মাছ ব্যবসার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরোনো। তবে এটি এখন গড়পড়তা সৌদিদের জন্য খুব পছন্দের কাজ নয়। বর্তমানে সৌদি আরবে মৎস্যশিল্পের বেশির ভাগ কর্মীই বিদেশি, বিশেষ করে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন বলে জেদ্দার কেন্দ্রীয় মাছবাজারটি স্থানীয়ভাবে ‘বাংলা’ নামে পরিচিত।
বাজারে কর্মরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা হলো প্রাণখুলে। জানা গেল, প্রায় সারা রাত মাছ ধরে সকালের আলো ফুটতেই এখানকার শতাধিক দোকানে জেলেরা তাঁদের ধরা মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। সৌদি আরবের অন্যতম বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক মাছ এখানেই পাওয়া যায়। বাজারের পাশে রয়েছে একটি রেস্তোরাঁ। টাটকা মাছ কিনে সেখানে সঙ্গে সঙ্গে রান্না করে খাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। চাইলে প্যাকেট করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।

বাজারে সিবাস, টুনা, স্কুইড, কাঁকড়া, লবস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে লাল গ্রুপার (নাজিল) এবং নেপোলিয়ন রাস (তারাবানি) এখানকার জনপ্রিয় মাছ। এ ছাড়া মিসরীয় প্যারট ফিশ, ওমানি সার্ডিনসহ বিভিন্ন স্থানীয় মাছও এখানে বিক্রি হয়। স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে হলে ‘বালাদি’ চিহ্নিত মাছ কেনাই উত্তম। যারা মাছ ধরতে আগ্রহী, তাদের জন্য বাজারে আধুনিক ছিপ, টোপ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পাওয়া যায়।
জেদ্দার কেন্দ্রীয় মাছবাজার প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে ভোরবেলাই বাজার সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে। আর বেশি ভিড় জমে শুক্রবার সকালে। কারণ, সপ্তাহান্তের শুরুতে জেদ্দার মানুষ মাছ কেনার জন্য বাজারে আসেন।
এ ছাড়া মক্কার কাকিয়াতে এসব সামুদ্রিক মাছ কাঁচা ও রান্না করা—দুইভাবেই কেনা যায়। মক্কায় প্রতি কেজি এসব মাছের দাম ৪০ থেকে ৮০ রিয়াল, যা বাংলাদেশি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার সমান।
জেদ্দার কেন্দ্রীয় মাছবাজারটি সৌদি আরবের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিদেশি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের এক প্রতিচিত্র। যাঁরা জেদ্দায় যাবেন ঘুরতে, তাঁরা এই বাজার দেখতে ভুলবেন না
যেন। মাছের রঙিন সমারোহ, কর্মব্যস্ত শ্রমিকদের মুখের হাসি এবং তাজা সামুদ্রিক খাবারের স্বাদ—সব মিলিয়ে এটি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে এখানে এলে।