সবাই মিলে ধরলো কবির আত্মজীবনী নেই, ব্যক্তি কবি সম্পর্কে আমার পক্ষেই লেখা সম্ভব। বলতে পারো নিজের বই ‘মানুষ জীবনানন্দ’ লিখতে হয়েছিল চাপে পড়ে। অনুরোধের বাইরে আমার মধ্যেও আসলে চাপ তৈরি হয়েছিল নিজের আর তোমার দাদার সম্মান বাঁচাবার জন্য। তোমার দাদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে তখন, কিন্তু যেভাবে তাকে আর আমাকে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। দেখলাম পত্রিকায় যত যা লেখা হচ্ছে তার অনেক কিছুই আমি জানি না বা আমার চেনা মানুষটার সাথে মেলে না। তার সাথে আমার সখ্য তেমন ছিল না সত্য, আনন্দময় স্মৃতি নেই তেমন, তবে যৌথ-যাপন তো ছিল দুটি সন্তান নিয়ে। সেখানে অন্যান্য সংসারের মতোই আশা-হতাশা-খুনসুটি সবই ছিল, মানুষটির আচার আচরণ কিছুটা জানা বোঝা হয়েছিল। তবে সংসারে যেভাবে চিনেছি ভেবেছিলাম পরে দেখলাম তা-ই সব নয় অন্যরকম চেহারাও তার আছে। যার যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বলছিল, লিখছিল, বিশ্লেষণ করছিল যার ভিত্তি কীনা মূলতঃ তোমার দাদার গল্প উপন্যাস। আমার অল্প বয়সের আবদার-আহ্লাদী স্বভাবটিকেও শত্রুপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো! অনেক কাহিনি জেগে উঠছিল। অবশ্য এও সত্য যে একজন লেখক তো সাধারণ মানুষের মতো একরৈখিক সহজসরল মানুষ নয়। তার বহুরৈখিক মনের অনেক রূপ সময়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সংসারে সেই ভিন্নতা তেমন বোঝা যায় না, মৃত্যুর পর পড়তে পড়তে আর শুনতে শুনতে আমিও তার অনেক রূপের সন্ধান পেলাম। বেঁচে থাকতে তোমার দাদার লেখা নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে, মৃত্যুর পর সেই লেখা দিয়েই আমাকে নিষ্ঠুরভাবে কাটাছেঁড়া করা হলো।
তার সম্পর্কে যা লেখা হচ্ছিল দেখলাম আমার চোখে তা ভুল খুবই ভুল। তার এমন দীন-হীন, ব্যক্তিত্বহীন বেচারা চেহারা আঁকা হলো যে আমার ননদ সুচরিতাও অনেককে অনেকভাবে প্রতিবাদ জানালো। অবশ্য তাতেও আমি বাঁচতে পারলাম না। আমার তো কারো কাছে কিছু বলার সুযোগই ছিল না, আমিই তখন বড় ভিলেন। এটা আরও বেশি হলো আমি মাল্যবান ছাপানোর বিরোধিতা করেছিলাম বলে। আমি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম সেই নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হয়েছে সাহিত্যমহলে। অনেকভাবে চিমটি কাটা হয়েছে আমাকে। তারাও তোমার মতোই একচক্ষু। কিন্তু মানবিক হলে আমার অর্ধোন্মাদ দশার কথা বিবেচনায় আসতে পারতো।
ভাবো তো প্রায় পঁচিশ বছরের সংসার জীবনের নিত্য লড়াইয়ে আমি আক্ষরিক অর্থে মানসিক আর শারীরিকভাবে যে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম এতো আমার কথা নয় ডাক্তারেরই কথা। শেষ সময়টায় অর্থ্যাৎ তার মৃত্যুর আগের সময়টায় আমি একটা চাকরি পেলাম, সেও একটা চাকরি পেলো। আমি ভাবছি এবার একটু থিতু হবো, মেয়ের বিয়ে দেবো, ছেলের ভবিষ্যত গড়বো—সেই সময়ে তার এমন অদ্ভূত নাকি উদ্ভট মৃত্যু হলো! সবাই বললো ট্রামের নীচে গোরুও পড়ে না সুতরাং এটা আত্মহত্যা। রহস্যের পর রহস্য জন্ম নিতে লাগলো আর সকলেই বক্র দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো আমার দিকে। আমার ছিদ্র খোঁজা শুরু হলো, হাসপাতালে কখন যাই, কতক্ষণ থাকি, কেমন সেবা করি ইত্যাদি। ওই বক্রদৃষ্টি, ফিসফিসানির পরিবেশই বরং আমাকে টিকতে দিতো না। এই পরিস্থিতি তার মৃত্যুর পর আরও কঠিন হয়েছিল। মাল্যবান যেই সময়ে লেখা হয়েছে তখনও উপন্যাসে অত পরীক্ষানীরিক্ষা শুরু হয়নি, তোমার দাদাই বোধহয় তা শুরু করেছিল। কিন্তু তখন কে তা বুঝতো? পাঠক মূলত গল্প-উপন্যাস একটি জম্পেস কাহিনির মতোই পড়তে অভ্যস্ত ছিল। তখন মাল্যবান ছাপা হলে মাল্যবানের উৎপলাকে লাবণ্য পড়তে শুরু করতো সবাই। কাজেই মাল্যবান ওরফে জীবনানন্দ দাশ যে উৎপলা ওরফে লাবণ্য দাশের উপন্যাস কথিত অত্যাচারে আত্মহত্যা করেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকতো কিছু?
একদিকে চতুর্মূখী মানসিক চাপ, অন্যদিকে তোমার দাদার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করাতে হলে আবার কোথায় হাত পাতবো সেই চিন্তা! তার ভাইবোনের অনুদানেই বলা যায় জীবন কেটেছে। এমনকি একটা সময়ে আমার মেয়েকেও খরচ চালাতে না পেরে কখনো তার কাকার কাছে কখনো পিসির কাছে রেখেছি। মাত্র কয়েকটি মাস একটু সুস্থির হতে পারবো ভাবছিলাম কিন্তু তা আর হবে না। তোমার দাদা আবার চাকরি হারাবে, পঙ্গু হয়ে চিকিৎসার খরচ বাড়াবে এই ভাবনাতেই মুহ্যমান ছিলাম—মারা যাবে তখনও ভাবিনি কিন্তু যখন তা স্পষ্ট হলো তখন তো বুঝলাম দুটি সন্তানের ভবিষ্যত একেবারেই ঝরঝরে! তাদেরকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কিভাবে বাঁচবো এই চিন্তা কি অমূলক বলো তো? এসব ভাবনায় একটা মুহূর্ত আমি স্থির হতে পারি না, একফোঁটা ঘুম হয় না। তোমার দাদার ওপর খুবই রাগ হয়েছিল। হ্যালুসিনেশন হতো, সারারাত ঝগড়া করতাম, জিজ্ঞেস করতাম কোন জন্মের পাপের শোধ নিচ্ছে! বিয়ের পর যেমন বলেছিলাম বিয়ে করে আমার জীবন নষ্ট করেছ মৃত্যুর পর তেমনি বললাম, এভাবে মরে গিয়ে আমার এবং সন্তানদের জীবন নষ্ট করেছ।
তার প্যাশনের কারণে ঘরে বাইরে কত অপমান যে সইতে হয়েছে এই একটা জীবনে! অনুভূতিহীনই যদি হবো তাহলে কী করে আমি সইলাম সে সব অপমান! ভুলিনি কিছুই, কী করেই বা ভুলব? ভুলতে তো পারিই না, কাউকে বলে যে একটু হালকা হবো তাও পারি না। সত্যিই কি মানুষকে সব বলা যায়? বলা যায় মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া বাকি পড়লে কীভাবে বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখাতো? মুদি দোকানের বাকি শোধ দিতে না পারলে দোকানদার কথা শুনিয়ে যেতো? জন্মের পর থেকে যে বিদ্যুতের আলো দেখেছে বিয়ের পর তার জীবন অন্ধকারময় হয়ে উঠলো, এমনকি কলকাতায়ও আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না এতটাই গরীব হাল তখন। তার ওপর টাকার অভাবে সেই ছোট বাড়িটিও সাবলেট দিয়ে কেমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তোমাদের মতো কাছের দু-একজনকে ভেতরে জমা ক্ষোভের কথা বলেছি কিছু তার তো বেশ ভালো প্রতিদানই দিয়েছো তোমরা!
হ্যাঁ ঠাকুরঝি বাইরের মানুষকে তো বরং মুখ বড় করে তার কবিতার কথা বলতাম। কত বড় কবি সে, গর্ব করে তা জানান দিতাম। বনলতা সেন তখন বেশ পরিচিতি পেয়েছিল তো বলতাম ‘বনলতা সেন’ আমাকে নিয়েই লেখা। একটা সময় সত্যিই ভাবতাম বনলতা সেন কেবলই এক রূপসী; নিজেকে সেই আয়নায় রেখেছিলাম। আমার চুল, আমার অতি সুন্দর চোখ দুটিকে বনলতা সেনের নিখুঁত কারুকার্যময় মুখে বসিয়ে নিজেকেই দেখতে পেতাম। আস্তে আস্তে সে ভুল আমার ভেঙেছে। তবু ঢং করে একদিন জিজ্ঞেসও করেছি, যদি আমাকে করুণা করে যদি একটু দাম্পত্য সুখের লোভেই মিথ্যামিথ্যি আমাকে সান্ত্বনা দিতে ভাণটুকু করে। ভাণ যে সে করতো না তাতো না। কেন কে জানে নিজেকে অতি নিরীহ, নির্বোধ দেখাতে পছন্দ করতো সে।
বনলতা সেনের পাখির নীড়ের নিবিড়তায় আশ্রয় দেয়া চোখ আমার মধ্যে তোমার দাদা কখনোই পায়নি এ আমার স্বীকার করতে হবে? তাহলে তার জীবন, তার সংসার, তার কবিতা বাঁচালো কে? এদিকওদিক থেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধনের শেষ সীমায় গিয়ে আমিই তো টেনেছি সব নাকি? তার ডায়েরি দেখো সে বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আত্মহত্যার প্ল্যান করেছে, আর লেখাগুলোতে ঠিক তেমনি দেখো বউ মরে যায় নয় আত্মহত্যা করে কখনো বা সন্তান মরে যায়। এই সমাধান তো এ তো পলায়নপরতা? বাস্তবে আমি কিন্তু পালাইনি, ক্রমাগত লড়াই করেছি। তারপরেও এ কথাই প্রতিষ্ঠিত যে আমার কাছে মানসিক আশ্রয় সে পায়নি। কিন্তু তুমিও তো আশ্রয় হয়ে উঠতে পারোনি? তুমি পালিয়েছিলে, তুমি হেরোদিয়াসের কন্যা আশ্রয় নও, তার হতাশা ছিলে। তবু নির্মম পরিহাস এই যে সবাই বললো, নিশ্চিতভাবে তুমিই ছিলে তার আশ্রয়। তুমি কী করলে তাতো আর বিষয় না কবি তোমাকে আশ্রয় করেছে সেটাই বড় কথা। আমি অবশ্য তোমার দাদার হাতে পড়েই আশ্রয়হীন হবার অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম।