Homeঅর্থনীতিরোজার বাজারে পুরোনো দৃশ্য

রোজার বাজারে পুরোনো দৃশ্য


রাজধানী সেগুনবাগিচা বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার রোজার বাজার করতে গিয়েছিলেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিজীবী মো. মতিউর রহমান। দোকানে গিয়ে হাতে থাকা ফর্দের প্রথম পণ্যটিই পাননি তিনি। অনেকটা হতাশার সুরে এই ক্রেতা বলেন, রোজার বাকি আর মাত্র দু-দিন। নিয়মিত বাজারের সঙ্গে রমজানের কিছু বাড়তি পণ্য যোগ হয়েছে ফর্দে। কিন্তু ফর্দের প্রথম পণ্য ভোজ্যতেলই পাচ্ছি না বাজারে।

মতিউরের মতো অনেকেই গতকাল রমজান মাসের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাজারে গিয়েছিলেন। এতেই চাহিদা বেড়েছে তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, বেসন, মাছ, মাংস ও কিছু তরিতরকারির। বাড়তি চাহিদার কারণে এবারও পুরোনো দৃশ্যপটে ফিরে গেছে রোজার বাজার। দাম বেড়ে গেছে প্রায় সব পণ্যের।

বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার চালের দাম বেড়েছে ১৬-১৭ শতাংশ। ছোলাসহ রোজায় চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যও গত বছরের তুলনায় এবার ৯-১০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তার ওপর নতুন করে বেড়েছে মুরগি, গরুর মাংস, লেবু, শসা, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। গত বছরের চেয়ে ১৯-২০ শতাংশ বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে ভোজ্যতেল।

রোজার মাত্র দু-দিন আগেও বাজারে সয়াবিন তেল না পেয়ে ক্রেতার সঙ্গে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন খুচরা বিক্রেতারাও। তাঁরা বলছেন, ‘কাস্টমারের কাছে জবাবদিহি করতে করতে আমরা হয়রান হয়ে যাচ্ছি। সবার একই প্রশ্ন, তেল নেই কেন? বারবার চেয়েও কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তেলের সরবরাহ পাচ্ছি না।’

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার আশ্বাস, পণ্যের ব্যাপক আমদানি ও সবজির মৌসুম—এসব কারণে এবার সাধারণ ক্রেতারা আশা করেছিলেন রোজায় বাজার স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু ক্রেতার সে আশার গুড়ে বালি। বাজার ঠিকই গরম হয়ে উঠেছে।

৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের সংকট কেটে যাবে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা ও মিলমালিকেরা। কেউ তাঁদের কথা রাখেননি। বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ নেই বলেই চলে।

গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ছয়টি দোকানের কোনোটিতেই সয়াবিন তেল নেই। প্রায় একই অবস্থা রামপুরা, মালিবাগসহ অন্য বাজারগুলোতেও।

সেগুনবাগিচা বাজারের মুদিদোকানি মোস্তাফিজুর রহমান সিফাত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাজারে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এত দীর্ঘ সময় তেলের সংকট এর আগে কখনই হয়নি। বিশেষ করে রোজার দু-দিন আগেও কোম্পানিগুলো বাজারে তেল দিচ্ছে না। এ বিষয়ে কারও তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখছি না। ভোজ্যতেলের সরবরাহ না থাকায় কাস্টমারদের গালি শুনতে হয় আমাদের।’

শান্তিনগর বাজারের তীর ব্র্যান্ডের ডিলার মো. জিয়া বলেন, ‘তেলের সরবরাহ না দেওয়ায় আমি সয়াবিনের ডিলারশিপ স্থগিত রেখেছি। কারণ তেলের সাপ্লাই নেই, আমার কাস্টমারদের মাল দিতে পারেননি। স্থগিত না করে উপায় নেই।’

বাজারে কিছু খোলা সয়াবিন তেল ও পাম সুপার পাওয়া যায়। কিন্তু তাও সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। গড়ে সব তেলের দামই এখন ১৯০-২০০ টাকা লিটার। অথচ সরকারনির্ধারিত দাম ১৫৭ টাকা লিটার।

১২ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে একই আশ্বাস দিয়েছিল ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ঋণপত্রও (এলসি) বেড়েছে একই হারে। শুধু তা–ই নয়, বিশ্ববাজারেও এখন পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল।

সরকারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসাবে, বর্তমানে বাজারে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৯ শতাংশ বেশি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘এবার পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই দেশে। সরকার বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে দেশে পণ্যের মজুত বাড়িয়েছে। কিন্তু সমস্যা তৈরি করছেন যাঁরা সরবরাহ করেন, তাঁরা। আর এটি নজরদারি করার মতো প্রশাসনেও তেমন লোক নেই। ফলে যে যেভাবে পারছেন, দাম বাড়াচ্ছেন। অথচ এবার পণ্যের দাম কম থাকবে এবং বাজার স্বাভাবিক থাকবে—এমনটিই আশা ছিল আমাদের। সরকারও সেভাবেই আশ্বাস দিয়েছিল।’

ভোজ্যতেল ছাড়া রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে ছোলা, চিনি, মসুর ডাল, বেসনের সরবরাহ সংকট নেই। তবে এসব পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২০, যা গত বছর রোজার আগে বিক্রি হয়েছিল ৯০–১১০ টাকা কেজি। টিসিবি বলছে, ছোলার দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ।

ভুট্টার বেসন ১৫০ ও অ্যাংকরের বেসন ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, বেসনের দাম প্রতি কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। তবে চিনির দাম ১২৫-১৩০ টাকা কেজিতে স্থির রয়েছে।

রোজার ঠিক তিন থেকে চার দিন আগে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে অন্যতম চাহিদার পণ্য মুরগি ও গরুর মাংসের বাজার। রাজধানীর বাজারগুলোতে গতকাল ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০-২২০ টাকা কেজি। আর সোনালি জাতের মুরগি বিক্রি হয়েছে ৩১০-৩২০ টাকা কেজি। অথচ গত মঙ্গলবারও বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৯০-২০০ টাকা কেজিতে।

গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৫০ টাকা করে বেড়ে ৭৮০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের দাম শবে বরাতের আগে বাড়লেও মাঝখানে কয়েক দিন কিছুটা কমে বিক্রি হয়েছিল। চাহিদা বাড়তে থাকায় আবার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা।

রাজধানীর মুগদা বাজারের মাংস বিক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, হাট থেকে গরুপ্রতি ৫-৭ হাজার টাকা বাড়িতে দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তাই আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

রোজায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ফলের জুস দিয়ে শরবত তৈরির সামর্থ্য নেই। ভিটামিন ‘সি’র ঘাটতি পূরণে মাল্টা বা কমলাও কিনতে পারেন না। এই শ্রেণির রোজাদারের ভরসা হয়ে ওঠে লেবুর শরবত। রোজায় নিম্ন আয়ের মানুষের সবচেয়ে দুশ্চিন্তা থাকে লেবুর দাম নিয়ে। কারণ প্রতিবছর রোজা এলে লেবুর দাম বেড়ে যায়।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাজধানীর মানিকনগর ও রামপুরাসহ বিভিন্ন বাজারে ছোট আকারে লেবু বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা হালি, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২০-৩০ টাকা ছিল। মাঝারি আকারের লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪০-৬০ টাকা ও কিছুটা বড় আকারের লেবু কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা হালি, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০-৮০ টাকা হালি।

রোজায় চাহিদার বাড়ে বেগুনের। এবার সব ধরনের সবজির দাম যখন একেবারেই কম। তখন ক্রেতার আশা ছিল বেগুনের দামও কম থাকবে। কিন্তু দাম ঠিকই বেড়েছে। সপ্তাহখানেক আগেও বাজারগুলোতে যে বেগুন ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, সেই একই মানের বেগুন গতকাল বাজারে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লেবু ও বেগুনের সঙ্গে বেড়েছে শসা ও খিরার দামও। বাজারে খিরা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি, যা সপ্তাহখানেক আগে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা কেজিতে।

রাজধানীর মানিকনগর বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. মোতালিব বলেন, ‘চৈত্র ও বৈশাখ মাসে লেবুর ভরা মৌসুম। এখন চলছে ফাল্গুন মাস। তার ওপর দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় লেবুর উৎপাদন কম। তাই দুই সপ্তাহ ধরেই দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এর মধ্যে রোজার জন্য চাহিদা ৭-৮ গুণ বেড়েছে, তাই দাম আরও বেড়েছে।’

চাহিদার কারণে বেগুন ও শসার দামও বেড়েছে বলে এই বিক্রেতা বলেন। তিনি বলেন, প্রতিবছরই রোজা শুরু এবং তারপর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বাজার কিছুটা গরম থাকে। এবারও একই অবস্থা হয়েছে। যদিও এবার সবজির দাম তুলনামূলক অনেক কম। রোজা শুরুর এক সপ্তাহ পরই বাজার আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

এবার পেঁয়াজের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম হলেও গত এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে দেশে উৎপাদিত এই জরুরি পণ্যটির। গত বছর এ সময় পেঁয়াজের কেজি ছিল ১১০-১২০ টাকা। গতকাল রাজধানীর বাজারগুলোতে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগে ৪০-৪৫ টাকা ছিল।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত