Homeসাহিত্যঅনেকদিন ধরে খেলানোর পর লিখি : আনিফ রুবেদ

অনেকদিন ধরে খেলানোর পর লিখি : আনিফ রুবেদ


সাহিত্য বিভাগের নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিফ রুবেদ। জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্র, মন ও শরীরের গন্ধ, এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি, যে জীবের হাত নেই পা নেই পুরোটাই পেট ইত্যাদি। পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার। 

বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?

আনিফ রুবেদ: আমি যখন কাঁদি তখন আমি শুধু আমাকেই স্পর্শ করি। যখন কান্না কিছুটা থিতিয়ে আসে তখন অন্যসব কিছুকেও স্পর্শ করি মনে মনে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আর জীবের মন আর শরীর হাতড়ে হাতড়ে কান্নার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা। তাদের কান্না আর আমার কান্না মিলিয়ে দেখি। দেখতে পাই, আমার কান্নাই সবচেয়ে বড় কান্না নয় পৃথিবীর মধ্যে; পৃথিবীর অন্যসবের কান্নার তুলনায় খুবই সাধারণ। সব বেদনাই সাধারণ বেদনা; একটামাত্র বেদনা শুধু অসাধারণ, সেটা হলো বিশ্ববেদনা। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের সমস্তকিছুর ভেতরেই একটা ক্ষয় হওয়ার, ভয় পাওয়ার, ভেঙে পড়ার শব্দ বেদনার মতো বাজছে। পৃথিবীর সমস্ত কিছুই বেদনা যাপন করছে। এই বোধ তৈরির পর আমার কান্না তখন আরও বেড়ে যায়। এই কান্না সমস্ত সত্তার জন্য; এই কান্না কখনো থামে না আর। এই বিশ্ববেদনা নামক অনুভূতি আমাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আনিফ রুবেদ: একটা চকোলেটের খোসা যখন পড়ে থাকে তখন সেটা চকোলেটের খোসাই। কিন্তু ওই খোসাটার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। সামান্য বাতাসে তার কিছুটা উড়ে যাওয়া দেখি; মানুষের পায়ের আঘাতে কিছুটা স্থান পরিবর্তন করা দেখি; ধুলোবালি এসে পড়তে দেখি; খোসাতে হয়ত সামান্য চকোলেটের মিষ্টি কণা লেগে থাকে তাতেই পিঁপড়ার থোকা তৈরি হয়; কোনো একটা গাছের হলুদ পাতা এসে পড়ে ওই খোসার ওপর; পাতা সমেত ওই চকোলেটের খোসার ওপর কোনো মানুষ তার সমস্ত ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল একসময়; পিপড়ের পুরো থোকা পিষে মিশে গেল চকোলেটের কণার সাথে।

এসব দেখতে দেখতে একসময় আমার চোখ ক্লান্ত হয় আর এরপর আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে দেখতে থাকি। মনে মনে দেখার চেষ্টা করি, যে শিশু এই চকোলেট খাচ্ছিল তার মুখ; আমি দেখার চেষ্টা করি, যখন শিশুটা চকোলেটটা খাচ্ছিল তখন অন্যকোনো শিশু কি সেখানে ছিল না যার জিভও চাচ্ছিল একটা চকোলেট। আমি মনে মনে দেখার চেষ্টা করি, চকোলেট যেখানে তৈরি হচ্ছে সেই কারখানা, কারখানার ধোঁয়া, কারখানার শ্রমিক, সেই শ্রমিকদের শিশুদের মুখ; দেখি পিঁপড়েদের পিষে শরীরের রস। এসব দেখতে দেখতে যখন সেই বিশ্ববেদনার মুখোমুখি হই তখন কবিতা লিখি। জানি না যে, এটাই সাবলীলায় লেখা কিনা, স্বাচ্ছন্দ্য লীলায় লেখা কিনা!

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?

আনিফ রুবেদ: না, তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় আমি লিখি না। অনুপ্রেরণা বা অনুপ্রেরণার হৃদয়ের ভেতর আমার হৃদয়কে অনেকক্ষণ, অনেকদিন ধরে খেলানোর পর আমি লিখি। এবং লেখার পর আরও অনেকদিন ওই লেখার ভেতরে ডুবে ভেসে সাঁতারে থাকার পর একসময় লেখাটাকে চূড়ান্ত করি আমি। ধীরত্ব আমার হৃদয়ের, আমার মগজের একটা অঙ্গ।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?

আনিফ রুবেদ: মাঝে মাঝে আমি ধরতে পারি না, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য আমি বাক্য বেছে নিই নাকি বাক্যই প্রকাশ হওয়ার জন্য আমাকে বেছে নেয়। এটাকে আমি ‘নাজিল হওয়া’ বা ‘কেউ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে’ এই ধরনের ব্যাপার মনে করি না। ব্যাপারটা অনেকটা এমন—যখন কোনো কবিতা লিখি তখন কিছু একটা ভেবেই লিখতে শুরু করি কিন্তু লিখতে লিখতেই এমন একটা বাক্য বা শব্দের বা শৈলির ব্যবহার হয়ে গেল যা আমি ভাবিনি। পরবর্তীতে সেই বাক্য বা শৈলী যদি আমার নিজের ভালো লাগে তখন সেই বাক্যের দিকে আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি; আমার মনে হয় বাক্যটি নিজেই প্রকাশ হয়েছে আমার মাধ্যমে।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?

আনিফ রুবেদ: ভাবধারার দিক দিয়ে বাউল ঘরানাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে। সুতরাং বাউল ঘরানার যারা কবি বা পদ রচয়িতা আছেন তারা একটা প্রভাব তৈরি করেন আমার ভেতর। এক্ষেত্রে মহান লালন আমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহের জায়গা। এরপরই আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তার কর্মযজ্ঞের বিপুল পরিধি আমাকে এই বলে দেয় যে, একজন মানুষের পক্ষে বিশাল কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে। এরপর আছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তার রেখা থেকেও আমি অক্ষর তৈরি করার, সেই অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরি করার, বাক্যের আলোছায়া তৈরি করার অনুপ্রেরণা পাই।

আমি পাঠের ক্ষেত্রে অনেকটাই সর্বভুক আগুনের মতো। একেবারে প্রাচীন চর্যাপদ থেকে একেবারে যে কবি আজকেই তার প্রথম কবিতা লিখলেন তার কবিতাটিও সমান প্রলুব্ধ হয়ে পড়ি। ফলে প্রবীণ নবীন সকলেরই ভাবগত, প্রকাশগত, শৈলীগত প্রভাব থেকে যেতে পারে। কিন্তু অবিচ্ছিন্ন কোনো প্রভাব যেন না পড়ে সে প্রয়াস থাকে আমার।

বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?

আনিফ রুবেদ: কথাসাহিত্যের চর্চা করি। যখন যে ভাবনাটা আসে তখন সে ভাবনাটার মূর্তি নিজেই একটা ফর্ম দাবি করে বসে। সেটা কবিতা হতে পারে বা গল্প বা অন্যকিছু। তখন সেভাবেই লিখি। তবু একই সাথে কথা আর কবিতা নিয়ে কাজ করতে গেলে অনুভব করি, কথা রচনার ভেতর কবিতার শল্ক লেগে যাচ্ছে বা কবিতার গায়ে বসে যাচ্ছে কথাসাহিত্যের আসর। ব্যাপারটা কোনো কোনো সময় ভালো লাগলেও কোনো কোনো সময় বুঝতে পারি, নিজের মনের ভেতর যে মান আছে তার থেকে খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি বারবার পরিমার্জন করে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

আনিফ রুবেদ: আমার কবিতার প্রথম বই ‘পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ড পত্র’। মূলত আমি কবিতা লিখি বিচ্ছিন্নভাবে। একটা কবিতা যখন লিখি তখন সেই কবিতাটিই লিখি। এভাবে যখন অনেকগুলো কবিতা জমে তখন বইয়ের পরিকল্পনা করি এবং একটা প্যাটার্নের বা একটা ভাবধারার কবিতাগুলোকে একসাথে করি। আমার প্রথম বইয়ের ব্যাপারটাও তেমনই ছিল। তবে মনে আছে পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্রে যে-সব কবিতা আছে সেগুলো সবই গভীর রাতে খুব মগ্নতার ভেতর দিয়ে লেখা। পুরো পৃথিবীকে আমি একটা মাটির দলার মতো দুমড়েমুচড়ে ছেনে কবিতার ভেতর নিয়ে আসতাম। এক ধরনের ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব ভেতরে কাজ করত; কবিতার ভেতর যা লিখছি তার নিয়ন্তা আমিই। পরে কবিতা লেখার সময় সেই ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে আমার; এটা সম্ভবত কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া; হৃদয়ের চেয়ে বুদ্ধির দাঁত বড়ো হয়ে যাওয়া।
এখন আমার আরো মনে পড়ছে, একটি পত্রিকা ঠিক এমনই প্রশ্ন করেছিল আমাকে। আমি লিখেওছিলাম কিন্তু তারা সেটা প্রকাশ করতে পারেনি। তারা আমাকে ফোন করে জানাই, যেটা আমি লিখেছি সেটা তাদের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়; নির্দিষ্ট এক ধরনের মানুষের অনুভূতির দোহাই দিয়ে বলেন, প্রশ্নটার উত্তর আরেকটু অন্যভাবে লিখতে। ওই লেখাটি এখনও রয়ে গেছে অপ্রকাশিত।

বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?

আনিফ রুবেদ: সাধারণত সমকালীন কোনো বিষয় সাথে সাথেই আমার লেখায় উঠে আসে না। সমকালীন বিষয়গুলোকে আমি নিজের ভেতর নিয়ে একেবারে পিষে পিষে রস বের করার পর কোনো একসময় লেখাতে উঠে আসে। আবার সমকালীন ঘটনাগুলোকে অতীতের ঘটনাগুলোর সাথেও মিশিয়ে দেখার প্রবণতা আমার রয়েছে। সমকালীন ঘটনা আর অতীত ঘটনার একটা শরবত বানাই। পরে সেটা ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার দিকে ঠেলে দিই আর বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের সেই ঘটনাকেও দেখার চেষ্টা করি। এরপর অথবা এভাবেই আমার লেখায় বিষয়গুলো উঠে আসে।

বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?

আনিফ রুবেদ: আমার মনের ভেতর যে মান রয়েছে সেটাকেই গুরুত্ব দিই বেশি। ফলে পাঠকের মন্তব্য তেমন কোনো পরিবর্তন আনে না। কখনো হয়ত বাক্যগঠনের কিছুটা এদিকওদিক বা বানানের পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু লেখার আত্মা যে ভাব বা দর্শন তাতে এবং মূল শৈলিতে কোনো মন্তব্য পরিবর্তন আনতে পারে না।

বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

আনিফ রুবেদ: একটা খুব দীর্ঘ কবিতার কাজ করছি। কবে বের হবে জানি না। একটা কবিতাতেই একটা বই। আপাতত এটুকু বলা যাচ্ছে; যদিও এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয় জানি।
নতুন কোনো ধারা বা শৈলির কথা ভেবে রাখিনি আগেই তবে আমি সবসময়ই নতুন শব্দ তৈরির; নতুন ধারা বা শৈলী বের করার চেষ্টা করি। খুব যে সফল হতে পারি তা নয় তবু কিছু কিছু কাজ আমার মনের মানকে কিছুটা তৃপ্ত করতে পারে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত