একসময় কাঠের কারুকাজ শুধু আসবাব বা গৃহসজ্জায় সীমাবদ্ধ ছিল। সময় বদলেছে। এখন কারুকার্যখচিত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পুরো বাড়ি। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও। বাগেরহাট সদর উপজেলার করোরি এমনই এক গ্রাম। সেখানকার দক্ষ কারিগরেরা গড়ে চলেছেন একের পর এক দৃষ্টিনন্দন কাঠের বাড়ি। নাম ‘বোড টিইনি হাউস’। এটি শুধু একটি বাড়ি নয়; বরং সৃজনশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পুরো কাঠের কারুকার্যে তৈরি পরিবেশবান্ধব এ বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষতা আর শিল্পনৈপুণ্যের বার্তা দিচ্ছে বিশ্ববাজারে। আর বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, এটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশেও।
ইতিমধ্যে ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম দেখিয়েছে কেনার আগ্রহ। শিগগির বাংলাদেশের এই শতাধিক কাঠের বাড়ি স্থান পেতে যাচ্ছে দেশটির বিখ্যাত চিড়িয়াখানা ‘পাইরি ডাইজার’-এ। অর্থাৎ এটি শুধু একটি ব্যবসা নয়; বরং বাংলাদেশের রপ্তানি-বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা।
গ্রামেই কারখানা, কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত শতাধিক শ্রমিক
বাগেরহাট সদর উপজেলার করোরি গ্রামে গড়ে উঠেছে ন্যাচারাল ফাইবারের কারখানা। কাঠের বাড়ি তৈরির এ কর্মযজ্ঞ দেখতে এলেই বোঝা যায়—এটি শুধু ব্যবসাই নয়; বরং এক নতুন সম্ভাবনার জগৎ। কেউ কাঠ কাটছেন, কেউ দরজা-জানালা বানাচ্ছেন, কেউ আবার নিখুঁত হাতে কাঠ পলিশ করছেন। একেকটি কাঠের ঘর তৈরি হতে সময় লাগছে মাত্র ১৫ দিন। প্রতিটি ঘরেই থাকছে শোয়ার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, বেলকনি, এমনকি এসির ব্যবস্থাও। ইউরোপীয় ধাঁচে বানানো এ ঘরগুলো সম্পূর্ণ কাঠের।
শ্রমিকদের চোখে স্বপ্ন
এ প্রকল্পে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। তাঁরা যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। শ্রমিকদেরই একজন শহিদুল ইসলাম বললেন, ‘আমাদের তৈরি ঘর বিদেশে যাবে, এটি ভাবতেই ভালো লাগে। আরও ভালো লাগছে, আমাদের কয়েকজনকে ঘর সংযোজনের জন্য ইউরোপে পাঠানো হতে পারে। এটি আমাদের জীবনের বড় সুযোগ।’
আরেক কাঠমিস্ত্রি মোজাহিদ বললেন, ‘আমি অনেক ঘর বানিয়েছি। কিন্তু কাঠের চাল বা ছাদওয়ালা এমন নিখুঁত ডিজাইনের ঘর আগে কখনো বানাইনি। এখানে সামান্য ভুলেরও জায়গা নেই। সবকিছু মেপে, বুঝে করতে হয়।’
কারখানার নারী শ্রমিক পূজার কণ্ঠেও উচ্ছ্বাস, ‘আমরা সবাই মিলে কাজ করি, খুব ভালো লাগে। শুনেছি, এ ঘর বসানোর জন্য কয়েকজনকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হবে। এ রকম কাজ আরও থাকলে আমাদের জীবন অনেক উন্নত হতো।’
স্থানীয় কাঠ, আন্তর্জাতিক মান
এই কাঠের ঘর তৈরিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মেহগনি কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ঘরের ছাদ যাতে টেকসই হয়, সে জন্য বিশেষভাবে আমদানি করা আইপিই কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে থাকবে পানিপ্রতিরোধী প্রলেপ। কোনো রং করা হবে না, সম্পূর্ণ কাঠের স্বাভাবিক সৌন্দর্য বজায় থাকবে। প্রতিটি কাঠামো আলাদা অংশে ভাগ করে পাঠানো হবে বেলজিয়ামে, যেখানে তা সংযোজন করা হবে।
পুরোনো অভিজ্ঞতা, নতুন উদ্যোগ
ন্যাচারাল ফাইবার দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করছে। তাদের তৈরি কাঠের সাইকেল, সানবেড, হোটেলবেড, কুকুর-বিড়ালের খেলনা, কোকো ম্যাট, ডিসপোজেবল স্লিপারসহ নানা পণ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি ১২০টি বোড টিইনি হাউস তৈরির অর্ডার পায়। এরপরই শুরু হয় কাঠের বাড়ি বানানোর এ যাত্রা।
ইউরোপিয়ান পার্টনারদের আস্থা
বেলজিয়ামের ‘নোই বিল্ডার্স’ এবং গ্রিসের ‘কোকো ম্যাট’ এই প্রকল্পে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। সরেজমিনে ঘর তৈরির কারখানায় দেখা হয় কোকো ম্যাটের সহপ্রতিষ্ঠাতা পল এফমরফিডিসের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা চাই বিশ্বকে দেখাতে, পরিবেশবান্ধব উপায়েও কাঠের বাড়ি তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশের মেহগনি কাঠ এ প্রকল্পের জন্য পারফেক্ট। এই উদ্যোগ আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করবে।’
মোংলা বন্দর ব্যবহারের দাবি
ন্যাচারাল ফাইবারের কনসালট্যান্ট মো. মনিরুজ্জামান মোল্লা শাহিন জানালেন, ‘আমরা সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাই। কিন্তু এ ঘরগুলো যদি মোংলা বন্দর দিয়ে পাঠাতে পারতাম, তাহলে সময় ও খরচ অনেক কমে আসত।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ন্যাচারাল ফাইবারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ আহমেদ বললেন, ‘আমরা এর আগে ব্রিটেন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ পেয়েছি। এর অংশ হিসেবে প্রথম নমুনা ঘর বানাতে হয়েছে। এর আগে বেলজিয়ামের সেই পার্কে হাতি চলাচলের করিডর বানানোর কাজও আমরা করেছি। সেই কাজ ভালো হওয়ায় এবার তারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে।’
মোস্তাফিজ আহমেদ আরও যোগ করলেন, ‘আমাদের এই কাঠের বাড়ি বিশ্ববাজারে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। সরকার যদি সহায়তা দেয়, তাহলে আরও বড় পরিসরে কাজ করা সম্ভব হবে। এটি শুধু আমাদের জন্য নয়, দেশের জন্যও বড় অর্জন হবে।’
বিসিকের প্রতিক্রিয়া
বাগেরহাট বিসিকের কর্মকর্তা ইউনুস আর রাফি বললেন, ‘ন্যাচারাল ফাইবার দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করছে। এবার কাঠের বাড়ি পাঠানোর মাধ্যমে দেশের সুনাম আরও বাড়বে। এ ধরনের উদ্যোগ যদি বাড়ে, তাহলে আমরা আরও সহযোগিতা করব।’
সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
এই কাঠের বাড়ির রপ্তানি শুধু একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগই নয়, বরং বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। একদিকে স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে। কাঠের বাড়ির বাজার যদি সম্প্রসারিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ আরও বড় সুযোগের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে।