Homeঅর্থনীতিডলারের দরপতন ও বৈশ্বিক অস্থিরতায় সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী

ডলারের দরপতন ও বৈশ্বিক অস্থিরতায় সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী


সোনার দাম যেন লাগামহীন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ, আর দেশের বাজারে বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের অবমূল্যায়ন, বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বড় দেশগুলোর সোনা মজুতের প্রবণতাই এর অন্যতম কারণ।

তথ্য বলছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রতি আউন্স সোনার দাম ১৬১ ডলারের বেশি বেড়েছে, যা প্রায় ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, কয়েক মাস আগেও যে সোনার দাম ছিল অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল, এখন তা অপ্রত্যাশিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ২০০০ ডলারের আশপাশে, যা জুলাইয়ে ২৪০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর বাড়তে বাড়তে বর্তমানে এটি ২৯৩৪ ডলারে পৌঁছেছে। এক বছরে সোনার দাম বেড়েছে ৮৯৪ ডলার বা ৪৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে কেন বাড়ছে

বিশ্ববাজারে সোনার দামের ওঠানামার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে ডলারের দামের। যখন ডলারের মূল্য কমে, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প খোঁজেন, আর তখনই সোনার চাহিদা বাড়তে থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে বেশ কয়েকটি কারণ একসঙ্গে কাজ করছে, ফলে সোনার বাজার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার বাড়লেও শেয়ারবাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে বিনিয়োগকারীরা সোনার দিকে ঝুঁকছেন। একই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা যখন তীব্র হয়, তখন অনেক দেশ তাদের রিজার্ভের অংশ হিসেবে সোনার মজুত বাড়ায়। গত কয়েক মাসে চীন, রাশিয়াও ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের স্বর্ণভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। অন্যদিকে ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর যে বৈশ্বিক প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেটাও সোনার বাজারকে উসকে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের প্রয়াস চালানো হচ্ছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সোনা কেনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির প্রভাব

বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংকগুলো মনে করছে, ২০২৪ সালের মতো ২০২৫ সালেও সোনার দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকবে; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে সিটি ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে সোনার গড় দাম প্রতি আউন্স ২৮০০-২৯০০ ডলারের মধ্যে থাকবে। সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সোনার দাম ৩০০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বাণিজ্যযুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি আরও চাপে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকেই ঝুঁকবেন।

দেশের বাজারে বাড়ার নেপথ্যে

দেশের বাজারে আন্তর্জাতিক দামের প্রভাব তো রয়েছেই, কিন্তু এর বাইরেও কিছু অভ্যন্তরীণ কারণ কাজ করছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। এক বছরে বেড়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘যখন কোনো দেশ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা করে, তখন তারা নিজেদের রিজার্ভে সোনা বাড়াতে থাকে। বিনিয়োগকারীরাও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন। কারণ, সোনার দাম সাধারণত নিম্নমুখী হয় না।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ডলারের মূল্য কমে যাওয়া। তবে এবার ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার পর অনেক দেশ সোনার মজুত বাড়াচ্ছে কি না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

সোনার দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির যে সম্পর্ক

বেশির ভাগ গবেষক মনে করেন, সোনার দাম বাড়ার সঙ্গে সরাসরি মূল্যস্ফীতির সম্পর্ক নেই; বরং সোনার দাম বাড়ার মূল কারণ হলো ভয় ও অনিশ্চয়তা।

অর্থনৈতিক ইতিহাস বলে, ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় থেকে সংকট দেখা দিলে সোনার দাম বাড়ে। ১৯৭০ সালের সংকটের সময় প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩৫ ডলার থেকে বেড়ে ৫২৫ ডলারে উঠে গিয়েছিল। ১৯৮০ সালে সেটি হয় ৬১৫ ডলার। ১৯৯০ সালে কিছুটা কমে এটি ৩৮৩ ডলারে নেমে আসে। বিশ্বজুড়ে সংকট সৃষ্টি হলে সাধারণত মানুষ সোনার দিকে ঝোঁকে। কারণ, এটি মূল্য সংরক্ষণের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম। সাম্প্রতিক সময়েও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

সামনে কী অপেক্ষা করছে

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মনে করছে, সোনার এই ঊর্ধ্বগতি শিগগির থামবে না। যদি ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে এবং ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমতে থাকে, তবে আগামী কয়েক বছরে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের বাজারেও এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের সাবধানতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, সোনার দাম একবার বেড়ে গেলে তা আবার কমে আসতে পারে, যদিও ইতিহাস বলে, দীর্ঘ মেয়াদে সোনার মূল্য সাধারণত ঊর্ধ্বমুখীই থাকে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত