Homeঅর্থনীতিটাকা এখন ব্যাংকমুখী

টাকা এখন ব্যাংকমুখী


ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় টানা চার মাস ধরে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর ব্যাংকে টাকা ফেরায় গত কয়েক মাস ধরেই বাড়ছে ব্যাংকের আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাসে ব্যাংকে ফিরেছে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। নভেম্বর মাসে ফিরেছে ৩৫৪ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বরে ফিরেছে আরও ১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এতে ধীরে ধীরে ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ‘বালিশ বা কম্বলের নিচে’ লুকিয়ে রাখা টাকাও এখন ব্যাংকে জমা হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে।

অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে, ব্যাংকের বাইরে থাকলে টাকার হাতবদল হওয়া কমে যায়, যা দিনশেষে ‘মানি ক্রিয়েশন’ কমিয়ে দেয়। মানুষের হাতে থাকা টাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংকে ফিরলে একদিকে ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো হয়, অন্যদিকে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বিনিয়োগও বেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।

আমানত বাড়ছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৭৭ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৬ দশমিক ৫৪ লাখ কোটি টাকা। একইভাবে নভেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৬৩ লাখ কোটি টাকা— যা ২০২৩ সালের একই মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের নভেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত ছিল ১৭ দশমিক ৩১ লাখ কোটি।

অবশ্য গত আগস্টে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই মাসে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ০২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। ওই মাসে আগের মাসের তুলনায় আমানত বাড়ে ১৪ হাজার ২০৮ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বরে আমানতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়। অক্টোবরে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৫৫ লাখ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক মার্জের (একীভূতকরণ) খবর এবং জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের প্রভাবে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। এখন সেই টাকা আবার ফিরতে শুরু করেছে।

ব্যাংকে উত্তোলনের চেয়ে টাকা জমা হচ্ছে বেশি

মতিঝিল এলাকার বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দেখা গেল প্রায় সব ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে টাকা উঠানোর চেয়ে জমা দেওয়ার গ্রাহকের সংখ্যা বেশি। অবশ্য টাকা উঠানোর চেয়ে জমা দেওয়ার লাইনে গ্রাহকের সংখ্যা বেশি এর আরেকটি কারণ, জমা দিতে আসা অনেকেই বিদ্যুৎ বিল, গ্যাসের বিল দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। যদিও কয়েক মাস আগে পুরোই ছিল এর উল্টো। শুধু দুর্বল ব্যাংকই  নয়, ওই সময় বড় ব্যাংকের বহু গ্রাহক টাকা না পেয়ে ফিরে এসেছেন। বিশেষ করে ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী এক থেকে দেড় মাস টাকা উঠানোর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় ব্যাংকগুলোকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিয়েছে।

রাজধানীর মতিঝিল এলাকার একাধিক ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন টাকা জমা দেওয়ার গ্রাহক ধীরে ধীরে বাড়ছে।  ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, যারা টাকা উঠিয়ে বাসায় নিয়ে রেখেছিলেন তারা আবারও ব্যাংকে জমা রাখতে শুরু করেছেন।  তিনি জানান ইসলামী ব্যাংক এখন প্রচুর আমানত পাচ্ছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, ডাচবাংলা, ব্র্যাক ব্যাংক, এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালীসহ সব ব্যাংকেরই এখন আমানত বাড়ছে।

যে কারণে মানুষ আবারও ব্যাংকমুখী

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের সরকারের আমলের মতো এখন আর ব্যাংক লুট হচ্ছে না। এছাড়া ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, বেনামি ঋণ ইস্যু ঠেকানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভালো ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বেড়েছে। এতে বড় দুটি ব্যাংক যথা ইসলামী ও ইউসিবির অবস্থা আগের তুলনায় ভালো হয়েছে।

সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে। তারল্য সংকট কেটে যাচ্ছে।

টাকা তুলে নেওয়ার প্রভাব জুলাই-আগস্টে

সাধারণত প্রতি মাসে আগের মাসের তুলনায় আমানত বাড়ে। তবে ব্যতিক্রম ছিল জুলাই ও আগস্ট মাসে। এই দুই মাসে আমানত বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বা ডিপোজিট ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর এক মাস পর আগস্ট মাসে আমানত ১৭ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। অবশ্য সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমানত বৃদ্ধির এই প্রবণতা আগের বছরের স্বাভাবিক সময়েও ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের এই তিন মাসে খাতটিতে আমানত বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা।

অবশ্য ব্যাংক খাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে সেপ্টেম্বরে গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে ডিপোজিট তুলে নেওয়ার প্রবণতা কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত কয়েক মাস ধরে তারল্য সংকট কেটে যাচ্ছে। তার ভাষ্য, ‘আগের তুলনায় বর্তমানে আমানত তুলে নেওয়ার চাপ কমে এসেছে। এছাড়া আগে যেসব আমানত আসার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের আকারে বের হয়ে যেত, সেটি এখন কমে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে।’

হাতে রাখা টাকা কমেছে

জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯২ লাখ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এটি কমে ২ দশমিক ৭৬ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৫ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাস শেষে মানুষের হাতে ছিল ২ দশমিক ৭৭ লাখ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে সেটি কমে ২ দশমিক ৭৬ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের (২০২৩ সালের) ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫৫ লাখ কোটি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে নভেম্বরে আগের মাসের তুলনায় ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমেছে ৩৫৪ কোটি টাকা। নভেম্বর শেষে মানুষের হাতে ছিল ২ দশমিক ৭৭ লাখ কোটি টাকা। অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমেছিল ৫ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ছিল ২ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৪৬ লাখ কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতি মাসেই এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৯২ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সেপ্টেম্বর থেকে ফের ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে বাইরে থাকা টাকা।

সাধারণত, মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া বোঝা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা সরবরাহের ওপর। ছাপানো নগদ টাকার একটি অংশ কেন্দ্রীয় ও সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় গচ্ছিত থাকে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোর ভল্টেও কিছু টাকা থাকে। এ ছাড়া ছাপানো টাকার একটি অংশ থাকে মানুষের হাতে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত