দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকার কচুক্ষেতে ডিজিএফআই এবং উত্তরা ও আগারগাঁওয়ে র্যাবের আয়নাঘর পরিদর্শন করেন তারা।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ তাসনিম খলিল। ২০২২ সালে নেত্র নিউজে প্রকাশিত হয়েছিলো “আয়নাঘরের বন্দী” শীর্ষক বহুল আলোচিত একটি প্রতিবেদন।
আয়নাঘর ঘুরে কী কী দেখেছেন তাসনিম খলিল তা নিজের ভেরিফায়েড ফেসুবক পেজে লিখেছেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে এক পোস্টে আয়নাঘরের খুঁটিনাটি বিষয়টি তুলে ধরেন। যার শিরোনাম দেন, “আয়নাঘরে যা দেখলাম”।
তাসনিম খলিল লিখেছেন, বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতনকেন্দ্র জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)।
এর কোডনেইম বা ছদ্মনাম আয়নাঘর। এই আয়নাঘর নিয়েই ২০২২ সালে নেত্র নিউজে প্রকাশিত হয়েছিলো “আয়নাঘরের বন্দী” শীর্ষক প্রতিবেদনটি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেই আয়নাঘরে ঢুকছি, অথচ আমার মাথায় ঘুরছে আম গাছ আর কাঁঠাল গাছ। আম গাছ কি এমন নাকি কাঁঠাল গাছ ওমন? গাছ দেখলে চিনবো তো? ঘটনা হলো, আমাকে এই আয়নাঘরের পাশে একটা কাঁঠাল গাছ খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, “আয়নাঘরের বন্দী” প্রকাশিত হওয়ার পর এই বন্দিশালার বেশ কয়েকজন সাবেক বাসিন্দার সাথে আমার কথা হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি তাদের ইন্টারভিউ রেকর্ড করেছি। তাদেরই একজন সারভাইভার-৩। তার বর্ণনায় উনি দীর্ঘ কয়েকটা মাস যে সেলে ছিলেন সেই সেলের দরজায় দাঁড়ালে সামনের দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে একটা কাঁঠাল গাছ দেখা যেতো। সেই গাছটি খুঁজে পেলে ওই বর্ণনার একটা শক্ত ভেরিফিকেশন হয়।
অথচ বন্দিশালার গেটে দাঁড়িয়ে আমি কাঁঠাল গাছ দেখতে কেমন সেটাই ভুলে গেছি। ঠিক তখনই মনে পড়লো। আরেহ, এই গেটটাইতো একটা ভেরিফিকেশন! শেখ মোহাম্মদ সেলিম (সারভাইভার-১) যে কলাপসিবল গেটের কথা বলেছিলেন, কয়েক ধাপ সিঁড়ির কথা বলেছিলেন। এই সেই কলাপসিবল গেট, এই সেই সিঁড়ি। ওপরে সবুজের মধ্যে সাদা লেখা সাইনবোর্ড: “করোনা আইসোলেশন সেন্টার”।
নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ লিখেছেন, গেট দিয়ে ঢুকে করিডোর ধরে এগোলাম। ডান দিকের একটা রুমে অনেকগুলো কাঠের দরজা এবং লোহার শিকের দরজা ফেলে রাখা। আরেকটু সামনে যেতেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, “তাসনিম ভাই, এই আয়নাঘরের নামটা কিন্তু আমরা আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম।”
এই কথা বলা লোকটি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন বলে দাবি করেছেন তাসনিম খলিল। ওই অফিসার তাসনিম খলিলকে বলেন, “আপনি কী খুঁজছেন আমি জানি। বড় এগজস্ট ফ্যানগুলো খুঁজছেনতো? আসেন আমি দেখাচ্ছি।”
ফেসবুক পোস্টে তাসনিম আরো লিখেছেন, অফিসারের পিছনে হাঁটছি। দুই-তিনটা সরু করিডোর ধরে যেতেই উনি আঙুল তুলে দেখালেন, “ওই যে।” আমার বামে কয়েকটা সেল, ডানে দেয়াল আর সামনে ওই এগজস্ট ফ্যান। ফ্যান দেখতে দেখতেই বামে তাকালাম। দরজার ওপরে সেলের নম্বর লেখা। এটা ১৯ নম্বর সেল। সাথে সাথে ফোনের খোঁজে আমার হাত পকেটে। মোবাশ্বেরকে একটা ভিডিও কল করতে হবে।
তাসনিম খলিলের তথ্য অনুযায়ী, এই আয়নাঘরে একজন প্রাক্তন বন্দি মোবাশ্বের হাসান। তিনি খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক। এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন।
ওই সময় মোবাশ্বেরের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন তাসনিম খলিল। তিনি লিখেছেন, আমি ফোন নাকের ওপরে তুলে লোহার দরজা খুলে সেলে ঢুকি, “আপ্নেতো বলছিলেন আপ্নেরে ১৯ নম্বর সেলে রাখছিলো। দেখেনতো!” মোবাশ্বের ভিডিও কলে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রুমের দেয়াল, ওপরে ছোট এগজস্ট ফ্যান, “এইটাইতো মনে হইতেছে ম্যান!”
কিন্তু তার (মোবাশ্বের) আরো ভেরিফিকেশন দরকার, “সেল থেকে বাইর হইলে ডান দিকে কয়েকটা স্টেপ গেলেই একটা বাথরুম থাকার কথা, দেখেন।” আমি সেল থেকে বের হই, ডানে ঘুরি। সামনে কয়েক স্টেপ গিয়েই বাথরুমে ঢুকি। ভিডিও কলে মোবাশ্বের চিৎকার করে উঠে, “ইয়েস ম্যান! এই বাথরুম আমি ইউজ করছি। আমি এখানেই ছিলাম, আমারে এখানেই রাখছিলো!” ১৯ নম্বর সেলের ভেরিফিকেশন ডান।
এরপর মোবাশ্বেরের সঙ্গে কথা শেষ করে করিডোর এলাকায় যান খলিল। সেখানে দুই পাশে ১০টি করে মোট ২০টি সেল ছিল বলে ওই পোস্টে জানিয়েছেন তিনি। আরেকটা বাথরুমে একটা হাই কমোড। এগুলো হাসিনুর রহমান (সারভাইভার-২) যেমনটা বর্ণনা করেছিলেন, তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় বলে জানিয়েছেন তাসনিম খলিল।
ফেসবুক পোস্টে আরো লিখেছেন, আরেকটা সেকশনে যাই। এদিকে পাঁচটা সেলের দরজা, ওদিকে পাঁচটা সেলের দরজা। এই সেকশনে মোট দশটা সেল। এই সেকশনেই শেখ মোহাম্মদ সেলিম ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার-৩ ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার-৪ ছিলেন। ২০১৬ সালে এই সেকশনে যারা বন্দি ছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের নাম-বৃত্তান্ত আমার মুখস্ত। তাদের ওই থাকার সকল চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ঠিক বাইরে কয়েকটা কাঁঠাল গাছ। আমি চিৎকার করে নেত্র নিউজের ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি জীবন আহমেদকে ডাকি, “জীবন, জীবন! এইগুলা কাঁঠাল গাছ না?” “জি ভাইয়া, এইগুলা কাঁঠাল গাছ”। আমি হাসি। জীবন হাসে। নেত্র নিউজের স্টাফ রিপোর্টার মিরাজ হাসে। কাঁঠাল গাছগুলো ওরা মুছে ফেলেনি—আয়নাঘরের স্বাক্ষী হয়ে কাঁঠাল গাছগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
এ ইউ/