Homeঅর্থনীতিঈদ-বাণিজ্যে, অনিশ্চিত পরিস্থিতি,দুশ্চিন্তায় ছোট ব্যবসায়ীরা

ঈদ-বাণিজ্যে, অনিশ্চিত পরিস্থিতি,দুশ্চিন্তায় ছোট ব্যবসায়ীরা


সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের হাট, যেখানে প্রতিদিন ক্ষুদ্র তাঁতি তাঁদের বোনা কাপড় নিয়ে বসেন। সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিক্রেতারা এখানে এসে কাপড় কিনতে আসেন, অনেকেই এক মাসের কাপড় সংগ্রহ করেন এখান থেকে। ঈদুল ফিতরের আগের কয়েক সপ্তাহ এই হাটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এখান থেকেই ঈদের বাণিজ্য শুরু হয়। সাধারণত রোজার ২০-২৫ দিন আগে ব্যবসা জমে ওঠে। কিন্তু গত শনিবার এই হাটে গিয়ে দেখা গেল, চিরচেনা সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় এক দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে।

পাবনা থেকে আসা বিশ্বাস লুঙ্গির স্বত্বাধিকারী ইদ্রিস আলী বিশ্বাস জানান, তাঁর ২৩ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন সংকটের সম্মুখীন আগে কখনো হননি। সাধারণত ঈদের সময় বিক্রি ভালো হওয়ার কথা, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। সারা সপ্তাহে যে লুঙ্গি তৈরি করেন, তা বিক্রি করে শ্রমিকদের মজুরি, সুতার বিল, রং ও ডাইংয়ের খরচ মেটাতে হয়। কিন্তু আজকের হাটে যে অবস্থা, তাতে হাটের খরচও উঠছে না। এক দিনে মাত্র ৫০টি লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে, যা করোনার সময়ও তিন গুণ বেশি বিক্রি হতো। এমন পরিস্থিতি তাঁর ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া কঠিন করে তুলেছে।

শাড়ি উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা আব্দুস সবুর জানান, তাঁর পাওয়ার লুমে প্রতি সপ্তাহে এক শিফটে ১০০টি কাপড় তৈরি হয়। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ কাপড় বিক্রি হচ্ছে না। প্রায় অর্ধেক কাপড়ই বিক্রি না হয়ে জমে যাচ্ছে ঘরে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তাঁর ব্যবসা আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যবসা একদম ভালো চলছে না।

এখন শুধু এই হাটের ব্যবসায়ীই নয়, এভাবে সারা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সবাই দুশ্চিন্তায় আছেন। বিশেষ করে যাঁরা ঈদ সামনে রেখে পণ্য উৎপাদন করছেন, তাঁদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাঁদের ব্যবসা আরও বেশি সংকটে পড়েছে। বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা এখন বাড়তি পণ্য কিনছেন না। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কঠিন সংগ্রাম করছেন।

বিশেষ করে গ্রামীণ হস্তশিল্প, কাপড় উৎপাদন, মুদিদোকান, জুতা তৈরির ছোট ও মাঝারি কারখানার সঙ্গে জড়িতরা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনোমতে তাঁদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখছেন। এত দিন আশায় ছিলেন ব্যবসার এই মন্দা আসন্ন রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্য থেকে কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেবেন। সেই অনুযায়ী অনেকের প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখন আসল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রেতার অভাব। চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে গত বছরের তুলনায় পাইকারি বাজারে বিক্রেতাদের উপস্থিতি অনেকটাই কমে গেছে। এই পরিস্থিতি এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের চিন্তায় ফেলেছে।

বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই (ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প) রয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এক-চতুর্থাংশ অবদান রাখছে। এসব শিল্পে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ নিয়োজিত। তবে ২০২৪ সালের শেষে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটি খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকঋণ গ্রহণের কষ্টকর পরিস্থিতি ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য এক অভাবনীয় সংকট তৈরি করেছে। ব্যাংকঋণ বিতরণও কমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকঋণ পাওয়া গেছে ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ কম। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পরিচালন খরচ বেড়েছে, যা তাঁদের ব্যবসার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যদি এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হয়, তবে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আগামী ঈদে তাঁদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লভ্যাংশ বা আয় থেকে বঞ্চিত হবেন।

ফ্যাশন উদ্যোগ এবং ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পরিচালক সৌমিক দাস বলেন, ‘আমাদের বিক্রি ইতিমধ্যেই ১০-১৫ শতাংশ কমেছে। উপরন্তু, নানা ধরনের দুর্ঘটনার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এতে মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। ফাল্গুন, একুশসহ বিভিন্ন উৎসবের ব্যবসাও জমেনি। এখন সামনে ঈদ, আর আমরা তাতেও অনিশ্চয়তায় রয়েছি।’

সৌমিক দাস আরও বলেন, ‘বড় উৎসবগুলোর বিক্রি খারাপ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। আমরা যারা দেশীয় ফ্যাশন হাউস পরিচালনা করি, ঈদ শেষে শ্রমিকের মজুরি, কাপড়ের বিলসহ সব হিসাব মিটিয়ে দিই। যদি ঈদে বিক্রি ভালো না হয়, তাহলে সব পরিশোধ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে।’

অঞ্জন’স-এর স্বত্বাধিকারী শাহিন আহমেদ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘ঈদের আগে পরিস্থিতি যদি ভালো হয়, তবে আমরা আশা করছি ঈদে বিক্রি ভালো হবে।’

মুদিদোকানি এবং অন্যান্য খুচরা বিক্রেতাদেরও একই অবস্থা। রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের মুদিদোকানি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগামী শুক্রবার শবেবরাত। সাধারণত এক সপ্তাহ আগে থেকেই ক্রেতারা কেনাকাটা শুরু করেন। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। শবেবরাতের বিক্রি নেই এবং স্বাভাবিক বেচাবিক্রিও তেমন হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, মানুষ শুধু যা প্রয়োজন, সেটুকুই কিনছে। ঈদে কী হবে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত