বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা বাড়াতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অন্যান্য ভাতার পরিমাণও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভাতা বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়গুলো এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করেছে। কোন খাতে কত ভাতা বাড়বে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় তা চূড়ান্ত হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট কার্যক্রম মূল্যায়ন বিভাগের যুগ্ম সচিব শামীমা ফেরদৌস গতকাল সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। আজ (গতকাল) সোমবারের মধ্যে তারা প্রস্তাব পাঠাবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, সব মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানো হবে। আগামী এপ্রিল মাসের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় আলোচনার পর কোন খাতে ভাতা কত বাড়ানো হবে, সেই সিদ্ধান্ত হবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত রোববার সচিবালয়ে আজকের পত্রিকাসহ কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে যত ধরনের ভাতা দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই বাড়ানোর প্রস্তাব করা হবে। কারণ এখন ভাতার পরিমাণ খুবই কম। মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে, কাজের মজুরি বেড়েছে। এসবের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করব। বিভিন্ন খাতে ভাতা বাড়ালে নতুন অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত কত টাকা বরাদ্দ দিতে হবে, তাও আমাদের প্রস্তাবনায় থাকবে।’
সূত্র জানায়, বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা বাড়ানোর জোর সুপারিশ করবে মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী এবং চা-শ্রমিকদের ভাতা বেশি পরিমাণে বাড়ানোর প্রস্তাবও করা হবে।
অর্থ উপদেষ্টাকে সভাপতি করে গত ১০ সেপ্টেম্বর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটিতে খাদ্য, স্থানীয় সরকার, ক্রীড়া, মুক্তিযুদ্ধ, ত্রাণ, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টাকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
এই কমিটি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন; ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, জন্মগত হৃদ্রোগ ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা; চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা প্রদান, দরিদ্র মার জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কার্যক্রম, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
এখন কোন ভাতায় কত টাকা
বর্তমানে ৫৮ লাখ ১ হাজার বয়স্ককে মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই ভাতা বিতরণ শুরু হয়। ১১ ধাপে ভাতার পরিমাণ বেড়ে ৬০০ টাকা হয়েছে। ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাকে মাসে ৫৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭১০ জন অসচ্ছল প্রতিবন্ধী মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন।
অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরের ৬২ হাজার, মাধ্যমিকের ২৬ হাজার, উচ্চমাধ্যমিকের ৮ হাজার এবং উচ্চতর স্তরের ৪ হাজার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ভাতা দিচ্ছে সরকার। প্রাথমিক স্তরে ৭৫০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকে ৯০০ এবং উচ্চতর পর্যায়ে মাসে ১ হাজার ৩০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়।
স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করতে চার স্তরে ২২৫ জনকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকে ৭০০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকে ১ হাজার এবং উচ্চতর স্তরের শিক্ষার্থীদের মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল ২ হাজার ৬০০ হিজড়াকে মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়।
অনগ্রসর ও বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এই সম্প্রদায়ের স্কুলগামী প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ৭০০, মাধ্যমিকের ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকের ১ হাজার এবং উচ্চতরের শিক্ষার্থীদের মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল বেদেকে মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
দুস্থ চা-শ্রমিকদের পরিবারকে বছরে এককালীন ৫ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। এখন ৬০ হাজার চা-শ্রমিক এই সহায়তা পাচ্ছেন। এর বাইরে ক্যানসার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত নির্বাচিত গরিব রোগীকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভিজিএফ, কাবিখা, কাবিটা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, জিআর (খাদ্য) এবং গৃহ বাবদ নগদ টাকা দেওয়া হয়।
নারী ও শিশুদের উন্নয়নে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকেও জেলেদের বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়া হয়। এসব ভাতার পরিমাণ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি।