একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিত করা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনার ভাষ্যকে পরিবর্তন করে পুনঃপ্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবনার সেই ভাষ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়টি উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ জমা দিয়েছে কমিশন। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি’ এই বিধানটি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবেন’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের জন্য বলেছে।
প্রতিবেদনে প্রস্তাব করা হয়েছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম দশ ভাগ প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স হবে ২১ বছর।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন আরও চারটি মূলনীতির সুপারিশ করেছে তারা।
শনিবার (৮ জানুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে সংবিধান সংস্কার কমিশনের (প্রথম খণ্ড) পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর আগে ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় সংবিধান সংস্কার কমিশন।
গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজকে প্রধান করা হয়।
বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেগুলো হলো, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতির মধ্যে শুধু গণতন্ত্রকে প্রস্তাবিত নতুন পাঁচ মূলনীতির একটি হিসেবে রাখা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ করা নতুন পাঁচটি মূলনীতি হলো, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলনের আদর্শকে সামনে রেখে কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি। যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে।’
কমিশন অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কেও সুপারিশ করেছে। তারা বলেছে, আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করছে। এই সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন হবে, তবে যদি নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় সে ক্ষেত্রে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ মাত্র এই সরকারের মেয়াদের অবসান ঘটবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাতটি মূল সুপারিশের সারসংক্ষেপ হলো-
১. সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র প্রস্তাব রেখেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
২. ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা।
৩. প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস।
৪. অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব।
৫. বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ।
৬. শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ।
৭. মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
কমিশন, সংবিধানের ৭(ক), ৭(খ), ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪১(খ), ১৪১(গ) ও ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্তি এবং এ সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফশিল সংবিধানে না রাখার সুপারিশ করেছে। ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাসসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ করার সুপারিশ করে কমিশন। জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০। নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, সরাসরি ভোটে।
এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারাও নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। বাকি পাঁচটি আসনের সদস্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনও কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) মনোনীত করবেন। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি।
সংস্কার কমিশন উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠনের জন্য বলেছে। কমিশন বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এছাড়াও কমিশন অধস্তন আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় আদালত ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে।
বিদ্যমান সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয়ভাগের অধিকারগুলো সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ নামে একটি একক সনদ গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিশন, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রধান এই তিনটির যে কোনও একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। এর পাশাপাশি অর্থ বিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে এবং আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সব সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল। এর ফলে প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পুঞ্জীভবন আরও ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরও প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচারবিভাগ ক্রমশ বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহির অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরও প্রবল চেহারা নিয়েছে। একইভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা দল, রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করেছে। এভাবে ১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দলকে কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশ জুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। অবশেষে যার উৎখাত হয়েছে ২৪এর জুলাইয়ে ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।