জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখনো রাজস্ব আহরণের আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিশেষ করে আয়কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এখনো অনেক পিছিয়ে। ২০০৫ সালে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দুই দশক পরেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আয়কর বিভাগের জন্য প্রয়োজন ১৬টি ডিজিটাল কার্যক্রম, কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে মাত্র তিনটি সম্পূর্ণ কার্যকর হয়েছে; সেগুলো হলো ইলেকট্রনিক ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন), ইলেকট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন (ই-রিটার্ন) এবং ই-ট্যাক্স অফিস। ২০২১ সালে চালু হওয়া উৎসে কর কর্তন (ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স) ব্যবস্থা এখনো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বাকি ১২টি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
সম্প্রতি এনবিআরের ই-ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের তৈরি করা ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অব ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর প্রশাসনের পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন হলে বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ হতে পারে। বর্তমানে, দেশের কর জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৬ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে এই অটোমেশন অপরিহার্য।
এনবিআরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, দেশের অবস্থান এখন প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের মাঝে রয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ধাপ পুরোপুরি অপ্রস্তুত, যা সময়ের সঙ্গে দ্রুত অগ্রসর হওয়া জরুরি। নইলে সংস্কারের লক্ষ্যও কোনো কাজে আসবে না।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ বলেছেন, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব এবং একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাব এই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজস্ব ব্যবস্থাপনার এই পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি গবেষণা অনুযায়ী, গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশগুলোর অন্তত ১২ শতাংশ কর জিডিপি অনুপাত থাকা উচিত।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আব্দুল হক এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, অটোমেশন হলে কর ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং অনৈতিক চর্চাগুলো বন্ধ হবে। তিনি আরও বলেন, কাগজবিহীন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা বাড়বে এবং সরকারি রাজস্বে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দেশের জন্য একটি কার্যকর এবং সুসংগঠিত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আগামীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। তবে বর্তমান অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে দেশে রাজস্ব আদায় প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু যথাযথভাবে ডিজিটালাইজেশন হলে তা দ্বিগুণ হতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, কর্মকর্তাদের কিছু অনীহাও অটোমেশনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁরা আশঙ্কা করেন, ডিজিটালাইজেশন তাঁদের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ করে দেবে।
তবে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য প্রভাবশালী মহল, ব্যবসায়ী এবং জনসাধারণের সহযোগিতা জরুরি। এই কারণে অগ্রগতি ধীরে ঘটছে।
যেসব জায়গায় পিছিয়ে
ডিজিটালাইজেশনে ধীরগতির কারণে এনবিআর প্রতিবছর তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, যেমন করপোরেট ইলেকট্রনিক রিটার্ন, ইলেকট্রনিক সাপোর্ট, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স: ওয়ার্ল্ড ডেটা, ইলেকট্রনিক রেভিনিউ অ্যাকাউন্টিং, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স এজেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স লিটিগেশন ম্যানেজমেন্ট, ইলেকট্রনিক কানেকশন, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স লেজার, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট ভেরিফিকেশন, ইলেকট্রনিক অডিট অব ট্যাক্স কেসেস, ইলেকট্রনিক অপারেশন অব এইচআর অ্যান্ড অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ডিজিটাল কনভারসেশন অব পেপার ডেটা। এগুলোর প্রক্রিয়া এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এসব বিষয়ে অগ্রগতির অভাবে করদাতাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এবং রাজস্ব সংগ্রহেও ক্ষতি হচ্ছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আয়কর ব্যবস্থার ধীরগতির ডিজিটালাইজেশন নিয়ে উদ্বিগ্ন। কাস্টমস দিবসে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়ার দিক থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি, অথচ সময় কম। এখনই আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সময় লাগে। পাশাপাশি প্রভাবশালী মহলের চাপ ও ব্যবসায়ী-জনসাধারণের সম্পৃক্ততার অভাবেও দেরি হচ্ছে।