শেয়ারবাজারে দরপতনে বিভিন্ন সময় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। এর অন্যতম প্রধান কারণ মার্জিন ঋণ নিয়ে করা বিনিয়োগে বড় লোকসান। তাই বিনিয়োগকারীদের হাহাকার বন্ধ করতে মার্জিন ঋণের বিষয়ে নতুন কিছু নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করতে যাচ্ছে পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স।
টাস্কফোর্সের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা পুঁজিবাজার সংস্কারে কয়েক ধাপে সুপারিশ প্রস্তাব করবেন। প্রথম ধাপে স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এমন কিছু সুপারিশ করা হবে। এই ধাপে মার্জিন ঋণ নিয়ে কিছু নতুন নীতি সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। এতে থাকছে, মার্জিন ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রোফাইল বিশ্লেষণের প্রস্তাব। গ্রাহকের ঝুঁকি গ্রহণ করার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করা হবে এতে। ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার সমঝোতার ভিত্তিতে। পোর্টফোলিওতে উল্লেখ থাকবে এই ঋণের সুদহার। এ ছাড়া ফোর্সড সেল বন্ধের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো চাপ দিতে পারবে না—এমন নীতি করার সুপারিশও করতে যাচ্ছে টাস্কফোর্স।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারী ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে যে ঋণ নেন, তাকেই বলা হয় মার্জিন ঋণ। বাজারে মন্দা চলার সময় শেয়ারের দরপতন একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে বিনিয়োগকারীকে অন্য উৎস থেকে টাকা দিয়ে ঋণ সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন ঋণদাতা। একে বলা হয় মার্জিন কল। মার্জিন কল পাওয়ার পরও বিনিয়োগকারী ঋণ সমন্বয় করতে ব্যর্থ হলে ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। একে বলা হয় ফোসর্ড সেল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে যে কেউ চাইলে মার্জিন ঋণ নিতে পারছেন। কিন্তু সেটা বন্ধের সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। প্রধানতম সংস্কার হচ্ছে গ্রাহকের প্রোফাইল। ব্যাংকের মতো করে ঋণগ্রহীতার রিস্ক প্রোফাইলিং করা হবে। গ্রাহকের বাজারে কত দিনের অভিজ্ঞতা আছে, মার্জিন নেওয়ার আগে ব্যবসার অবস্থা কী, মার্জিন নিয়ে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন কি না, বিনিয়োগের পর লোকসান হলে টাকা পরিশোধের সক্ষমতা আছে কি না ইত্যাদি বিষয় স্থান পাবে গ্রাহকের প্রোফাইল। এর ওপর ভিত্তি করেই মিলবে মার্জিন ঋণ।
মার্জিন ঋণের সুদের হারও নির্ধারিত হবে গ্রহীতা ও ঋণদাতার সমঝোতায়। যে ঋণ নেবে এবং যে দেবে, তাদের দুজনের পারস্পরিক সমঝোতায় সই করবে। প্রতিটা পোর্টফোলিওতে সুদের হার উল্লেখ করা থাকবে। যখনই মার্জিন কল আসবে, এসএমএস চলে যাবে ঋণগ্রহীতার কাছে। ফোনকল আসবে। লোকসানের টাকা জমা দিতে না পারলে শেয়ার বিক্রি হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ফোর্সড সেল নিয়ে টাস্কফোর্সের একজন সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি প্রতিষ্ঠানই ঠিক করবে, রেগুলেটর এতে হাত দেবে না। তারা বলবে না যে ভাই ফোর্সড সেল বন্ধ করেন, এই করেন, সেই করেন। এ ধরনের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের পর লোকসান হলে এবং মার্জিন কলের পরও বিনিয়োগকারী টাকা দিতে না পারলে তার শেয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রি হয়ে যাবে।’
তবে এসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য কেবল নীতিমালা নয়, আইন করতে হবে বলে জানান টাস্কফোর্সের ওই সদস্য। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। আইন হলে সবাই মানতে বাধ্য হবে।’
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও রেগুলেটর ফোর্সড সেল বন্ধ করতে পারে না। এখন করে। আইন করার অর্থ হচ্ছে, অনৈতিক চর্চা করা হয়, সেটা স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। আইন করলে তো আর বন্ধ হবে না।
টাস্কফোর্সের আরেক সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মার্জিন ঋণের কারণে বাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। নেগেটিভ ইক্যুইটি তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কী কী ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কেন সমস্যায় পড়েছে, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সার্বিকভাবে আমরা যে পদ্ধতি করে দিয়ে যাব, তাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা হবে না।’
জানা গেছে, সংস্কার নিয়ে টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো আসবে কয়েক দফায়। এপ্রিলের মধ্যে তিনটা বিষয়ে সুপারিশ করবে টাস্কফোর্স। এগুলো হলো আইপিও ভ্যালুয়েশন, মার্জিন রুলস ও মিউচুয়াল ফান্ড।
এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের এক সদস্য না প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই তিনটা বার্নিং ইস্যু। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ডিসক্লোজার লেভেলে কিছু আছে। সেটা পরের সেগমেন্টে আনব।’
জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘বাজারটাকে কে কী অবস্থায় নিয়ে গেছে, এখানে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের মাথাব্যথা হচ্ছে, যেসব কারণে বাজারের ম্যাসিভ পতন, ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিগুলো ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সেখানে আমরা পরিষ্কারভাবে লিখব। কী করলে আর এসব হবে না, সেগুলো জানাব। তখন এটার ব্যত্যয় যদি কেউ ঘটায়, সেই দায় আমাদের নয়।’
শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য গত অক্টোবরের শুরুর দিকে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এ এফ এম নেসারউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।
বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। বিএসইসি টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। আদেশে বলা হয়েছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে হস্তান্তর করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, আপাতত আমরা সপ্তাহখানেকের মধ্যে কিছু সুপারিশ ড্রাফট আকারে দেব, সরকার চাইলে যাতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।
অধ্যাপক হেলাল বলেন, সব শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু সব দিক থেকে প্রেসার আছে, সেহেতু কিছু কিছু করে শেয়ার করব। সবার শেষে প্রতিবেদন দেব।
টাস্কফোর্সের সদস্য এ এফ নেসারউদ্দীন বলেন, ‘বিএসইসি চেয়ারম্যান দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে শিগগিরই তাঁর কাছে আমরা প্রস্তাব জমা দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের (টাস্কফোর্স) ১৭টা টার্মস অব রেফারেন্সের ভিত্তিকে কাজ করতে বলা হয়েছে। সব শর্ত শেষ করতে গেলে দেড়-দুই বছরের ব্যাপার। সে জন্য আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যখন যেটা প্রস্তুত হবে, সেই সুপারিশ দিয়ে দেব। ড্রাফট ফরম্যাটে দেওয়া হবে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর চূড়ান্ত হবে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খন্দকার সাফফাত রেজা বলেন, ‘সংস্কার যখন হবে, তখন ভালোর জন্যই নিশ্চয় চেষ্টা করবে। রেগুলেটর যদি চায়, তাহলে গ্রাহকের কেওয়াইসি প্রোফাইল তৈরি করতে পারে।’