নেতৃত্বে দ্বিতীয় প্রজন্ম
পাবনার সুজানগর উপজেলার হাসামপুর গ্রামে সুভাষ চন্দ্র ঘোষের জন্ম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। খলিলপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর পাবনায় লজিং থেকে বনমালী টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। পাস করে সোজা ঢাকায়। ভর্তি হলেন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এ সময় খরচ চালাতে টিউশনিও করতে হয়েছে সুভাষ চন্দ্র ঘোষকে।
ব্যবসায়ী হবেন, এমন চিন্তাভাবনা কি ছোটবেলায় ছিল—এ প্রশ্নের জবাবে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘আমাদের পরিবারটা বিরাট। অনেকগুলো ভাইবোন। তাই চাকরি করে সংসার চালানো আমার পক্ষে সম্ভব না। ফলে আগে–পরে আমাকে ব্যবসা করতে হবে, এমন চিন্তাভাবনা ছিল।’
নির্মাণ ও আবাসন ছাড়া এবিসি গ্রুপের বর্তমানে এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টস ও এবিসি ফ্যাসিলিটিস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। গ্রুপের কর্মিসংখ্যা প্রায় এক হাজার।
এবিসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং পরিচালক আমীরুল ইসলাম প্রয়াত হয়েছেন, অবসরে গেছেন নজরুল ইসলাম। বর্তমানে এবিসি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। এবিসি রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন মোস্তাকুর রহমান। সাইফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর ছেলে রাশেদ এ চৌধুরী বর্তমানে এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টস ও এবিসি ফ্যাসিলিটিসের চেয়ারম্যান। নজরুল ইসলামের ছেলে প্রকৌশলী নাশিদ ইসলাম এবিসি লিমিটেডের দেখভাল করছেন। আর আবাসন ব্যবসা দেখছেন শ্রাবন্তী দত্ত ও সৌগত ঘোষ।
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, এবিসি গ্রুপে দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে ব্যবসার নেতৃত্ব হস্তান্তর খুবই ধীরস্থির ও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। শ্রাবন্তী ও সৌগতর মতো দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন, কেউ কেউ এখনো করছেন। প্রথম প্রজন্ম যখন তাঁদের যোগ্য মনে করেছে, তখনই তাঁরা পরিচালক পদে নেতৃত্বে এসেছেন।
শ্রাবন্তী দত্ত জানান, প্রায় ১১ বছর চাকরি করার পর তিনি পরিচালক পদ পেয়েছেন। এই ব্যবসার খুঁটিনাটি সিনিয়র সহকর্মীদের কাছ থেকে শিখে শিখেই এ পর্যায়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। বাংলাদেশের বেসরকারি মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের নিজস্ব তত্ত্বাবধান, পরিশ্রম এবং কর্মিবান্ধব মানসিকতা ছাড়া দীর্ঘ সময় প্রাতিষ্ঠানিক সুস্থ প্রবৃদ্ধি ও সুনাম ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
এ পর্যায়ে সৌগত ঘোষ বললেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই ব্যবসায়ী বাবাকে দেখে বড় হয়েছি। তারপর পড়াশোনা শেষ করে ২০০৯ সালে যখন যুক্ত হলাম, তখন অফিসে বসিয়ে না রেখে আমাকে পাঠানো হয় সাইটে, সরাসরি নির্মাণকাজে। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ শিখেছি। সে কারণে কোম্পানির সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আমাদের ভেতরে গেঁথে গেছে। আমি যদি এসেই পরিচালক পদে বসে পড়তাম, তাহলে কোম্পানি ও তার দীর্ঘ সময়ের সহযোগী কর্মী দলের সঙ্গে সংযোগটা দৃঢ় হতো না।’
বাংলাদেশে গত শতাব্দীতে শুরু হওয়া অনেক যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায় ভাঙন ধরেছে। এ ক্ষেত্রে এবিসি গ্রুপ ব্যতিক্রম। শুরুর দিকের পাঁচজনের মধ্যে দুজন প্রয়াত হলেও প্রজন্মান্তরেও অটুট আছে এই পার্টনারশিপ।
পাঁচ দশক ধরে টিকে থাকা এই বন্ধনের মূলমন্ত্র কী, জানতে চাইলে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘প্রতারণা, আর্থিক অসততা ও অনেক সময় ব্যক্তিগত ঈর্ষার কারণে যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসা টিকছে না। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সততা ও একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাই এত বছর একসঙ্গে থাকার পেছনে কাজ করেছে। স্বচ্ছতাও আমাদের আরেকটা শক্তি। প্রতিটি হিসাব, প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা স্বচ্ছভাবে করেছি। প্রথম প্রজন্মের জীবদ্দশায় পরবর্তী প্রজন্মের প্রদর্শিত দক্ষতা, শক্তি ও আগ্রহের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে মালিকানা ও দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’
সুভাষ চন্দ্র ঘোষ ব্যবসার ফাঁকে লেখালেখিও করেন। লিখেছেন তিন দুয়ারের কোলে নামের আত্মজীবনী। তাঁর ৮০তম জন্মদিনে ইউপিএল প্রকাশ করেছে বাংলার ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণী গ্রন্থ বিভেদবয়ান। তিন বছর আগে পাবনায় পৈতৃক ভিটায় নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন মেয়েদের জন্য অবৈতনিক উচ্চবিদ্যালয়। নাম সুধীর ঘোষ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র ঘোষ বললেন, ‘জীবন নিয়ে আমি স্যাটিসফায়েড (সন্তুষ্ট)। যখন যেটি করার প্রয়াস ও পরিকল্পনা নিয়েছি, তখন সেটি সার্থকভাবে করতে পেরেছি। এখনো আমি কাজ পছন্দ করি। সব দায়িত্ব তরুণ প্রজন্ম বুঝে নিলেও অভিভাবক হিসেবে আমি তাদের সঙ্গে আছি। আমৃত্যু এভাবেই তিলে তিলে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’