আত্মমগ্নতা থেকে বিশ্বজীবনের ব্যাপক পরিসরে ভ্রমণের আকুলতা এবং সেই সঙ্গে নিজের জন্মপুরাণের খোঁজে আত্মসন্ধানের হাহাকার একজন কবিকে নিঃসন্দেহে সমকালের অন্য কবিদের থেকে স্বতন্ত্র করে দেয়। কবিতা সময়চিহ্নিত, এমনকি কবিও; কিন্তু কবিতাবিচারের ক্ষেত্রে দশকভিত্তিক বিবেচনার প্রবণতা কবির ব্যক্তিস্বরকে অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কবিতায় যে ভাঙাগড়া ও উত্থান-পতন আমরা লক্ষ করি, তার অনেকটাই সময় ও সমাজের সাথে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু মহাকালের হিসেবে এই বিচার খণ্ডিত হতে বাধ্য। আমরা একজন কবিকে প্রথমত তার মগ্নতার স্বভাব অনুযায়ী শনাক্ত করি এবং সেই মগ্নতার ক্রমপরম্পরা কিংবা ক্রমবিচ্ছেদ আমাদেরকে সেই কবির কবিতালোকের স্বরূপ উপলব্ধিতে সহায়তা করে। মাসুদ খানের কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে উল্লিখিত বিবেচনা আমার কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়। একটা সময়ের অন্তঃস্বরকে ধারণ করতে পারা একজন কবির স্বভাব নিরূপণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবিতা থেকে আশির দশকের কবিতার স্বভাবধর্মের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এমন একজন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা তাদের সময়ের স্বরটিকে পরিপূর্ণরূপে ধারণা করতে সমর্থ হয়েছেন। মাসুদ খান তার কবিতাযাত্রার শুরুতেই সম্ভবত আত্মস্বরায়নের এই নিগূঢ় মর্মবাণী উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কবিতা যে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সময়ের কণ্ঠস্বর, এই সত্যটিও হয়তো তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। যে কারণে প্রথম কবিতাগ্রন্থ থেকেই তিনি অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও আবেগের এমন যৌথরাগ কবিতার শব্দগুচ্ছে তুলে ধরেন, যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনায়নের অস্থির তরঙ্গ উপলব্ধি করা যায়। তার ‘পাখিতীর্থদিনে’ কবিতাগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় কবির মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে অস্তিত্বগত নিঃসঙ্গতা ও আত্মসন্ধানের হাহাকার। মানুষ যে একই সঙ্গে নিজের ভূখণ্ড এবং বিশ্বজীবনের অংশ, এক গভীর বিজ্ঞানমনস্ক অনুধাবন থেকে সেই স্তরে উপনীত হয়েছেন তিনি। কয়েকটি দৃষ্টান্ত থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেখা যেতে পারে।
১.
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যাকর্ষণ।
তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।
[কুড়িগ্রাম, পাখিতীর্থদিনে]
২.
যদিও নদীকূলেই বাস চিরদিন আমাদের,
একেবারে নদীতীরে নয়, একটু দূরে।
তবে কি বিশ্বের সব বিস্ময়ের শুরু ওই ঘুমবিন্দু থেকে?
[কন্যাসংহিতা, ঐ।]
৩.
সম্প্রসারিত উপবাস আর তৃষ্ণার কাচ ফেটে
গড়িয়ে পড়ছে ছাইরঙা স্রোত জলে
বহুবল্লভ যাবে আজ খুব দূরে
তার সাথে যাও, দক্ষিণে যাও, যেখানে ইচ্ছা খুশি
ট্যান্টালাসের উত্তরসূরি তুমি।
[সমাবর্তন, ঐ।]
কেবল এই তিনটি দৃষ্টান্ত নয়, তার আরও অনেক কবিতার আত্মসন্ধানের সূত্রে জন্মপুরাণের এক বিশ্বজনীন সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। পুরাণ এবং বিজ্ঞান কালের দিক থেকে দূরবর্তী হলেও কবির উপলব্ধির কাছে অতিনিকটবর্তী দুটি প্রপঞ্চ। একজন বড় কবির ক্ষেত্রে এই দুইয়ের অস্তিত্ব পার্বতী-পরমেশ্বরের মতো অভিন্ন। উপমানটি বহুব্যবহৃত হলেও আমি মনে করি কবিতা বিচারের ক্ষেত্রে, কোনো কোনো সত্য সকল পাঠকের কাছেই প্রাসঙ্গিক। উদ্ধৃত তিনটি কবিতাংশ পাঠ করে আমার মনে হয় যে, বিশ্বচরাচরে কবি নিজের জন্যে একটি ভূখণ্ড সন্ধান করছেন। সেটা হতে পারে তার ব্যক্তির অস্তিত্বের অথবা সঙ্ঘজীবনাবেগের।
কবিতা কতটা বিজ্ঞাননিষ্ঠ হতে পারে সেটা বিবেচনাসাপেক্ষ। কিন্তু তার অস্থিমজ্জা ও রক্তপ্রবাহে যে এক প্রবল অধিবিদ্যক চেতনারাশি প্রবহমান কবিতার ইতিহাস থেকে সেটা আমরা বুঝতে পারি। টি এস এলিয়টের ‘ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভা’ এবং ‘দি মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস’ প্রবন্ধ দুটি পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে বোঝা যায় যে, একজন কবির অন্তর্লোক কতটা অধিবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তিপ্রতিভার সঙ্গে ঐতিহ্যের সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাখ্যা যতটা জনপ্রিয়, অধিবিদ্যক কবিতার ব্যাখ্যা কিন্তু ততটা জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু টি এস এলিয়টের আত্মস্বরূপের সুস্পষ্ট মানদণ্ড তার দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতেই ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে তার ‘সংবেদের পৃথকীকরণ’ (dissociation of sensibility) তত্ত্ব কবিতা বিচারের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। মাসুদ খানের কবিতায় যে বিজ্ঞান অনুষঙ্গের ব্যবহার রয়েছে, সেই বিজ্ঞান বোধের সঙ্গে পুরাণ এবং সামূহিক অবচেতনার গভীর যোগসূত্র সৃষ্টি করে। ‘ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম’ এর স্থবিরতা, ‘মাধ্যাকর্ষণে’র সঞ্চরণশীলতা, আবার ‘দূর শূন্যলোকে’র নিরুদ্দেশ গতিবিধি চৈতন্যের যে জঙ্গমতা সৃষ্টি করে, তা কেবল উপলব্ধি দিয়েই অনুসরণ করা যায়। ‘তবে কি বিশ্বের সব বিস্ময়ের শুরু ওই ঘুমবিন্দু থেকে?—পাঠককে নিয়ে যায় চৈতন্যের এক ভিন্নতর লোকে। এবং বহুবল্লভের পরিণতি যে ট্যান্টালাসের উত্তরসূরির উপলব্ধিতে, তাতেই বাস্তব থেকে, বিজ্ঞান থেকে, স্বপ্ন থেকে কীভাবে পুরাণের মধ্যে আত্মপরিচয়ের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় তার প্রমাণ নিহিত রয়েছে।
অভিজ্ঞতাঋদ্ধ আবেগ ও আবেগের অভিজ্ঞতায় প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘পাখিতীর্থদিনে’ থেকেই নিজের কবিমানসের ভূমিতল খুঁজে পেয়েছেন মাসুদ খান। এই ভূমিতল খুঁজে পাওয়া যে তার জন্মপুরাণের খোঁজ পাওয়া নয়, সেটাও তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। এই অতৃপ্তি ও অপূর্ণতাবোধই একজন কবিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, পথসন্ধানে সহায়তা করে। এখান থেকেই তিনি শনাক্ত করতে সমর্থ হন পুরাণ, বিজ্ঞান, ব্যক্তি ও সমষ্টির জগৎপরিসর। মানুষের জীবনে অতীতের স্বভাবেরই যে বারবার পুনরাগমন ঘটে, সেই নির্মম সত্যকেও তিনি ভুলে যান না। এই ভূমিপৃষ্ঠে কীভাবে ‘বৈশ্যদের কাল’ ফিরে আসে, কবির আগের জীবনে তার অভিঘাত তীব্ররূপ ধারণ করে। তবে এই কবিতার (বৈশ্যদের কাল) সবচেয়ে বাঞ্জনাময় ও চেতনাসঞ্চারী অংশ হলো—
সার্থবাহ নিয়ে আসে ঝলমলে বাসকপাতার কোলাহল
দুঃখ সেরে যায়, অসুখ সারে না
[বৈশ্যদের কাল, ঐ]
ব্যাখ্যাতীত অথচ ব্যঞ্জনাময় এই দুটি চরণের মধ্যেই বৈশ্যদের আধিপত্য কালের ক্ষয় এবং পুনরুত্থানের যন্ত্রণা অনুভব করা যায়। মাসুদ খানের কবিতার মধ্যে ইমারত নির্মাণের মতো এলিয়টীয় আয়োজন আছে, তবে তিনি কখনো কেন্দ্রাতিগ হতে চাননি, যেটা এলিয়টীয় কবিতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এই যে কেন্দ্রানুগ অনুভবের প্রতি মগ্নতা তা থেকেই কবির অস্তিত্বলগ্ন ও অস্তিত্বশূন্য জীবনরূপ অনুধাবন করা যায়—
তারপর ধূলিঝড় হলো, হিমবাহ গেল শতযুগ,
ধীরে ধীরে এই ভূমিপৃষ্ঠে ফিরে এল বৈশ্যদের কাল।
[বৈশ্যদের কাল, ঐ]
‘পাখিতীর্থদিনে’ কাব্যগ্রন্থে মাসুদ খান কেবল আত্মরূপ ও আত্ম-আবিষ্কারের ধরনই সন্ধান করেননি, তিনি মানুষের প্রত্নস্মৃতির অভিন্ন বিন্দুর অবস্থানও চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এবং তিনি আবেগ ও বিজ্ঞানের দ্বৈরথের এক অস্থির সমন্বয় সন্ধান করেছেন। বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যা উনিশ শতকে এসেই পরস্পরবিরোধী দার্শনিক বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কবিতা আদিকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা আজ পর্যন্ত মানবচৈতন্যের সকল বিরোধী বস্তু ও ভাবসত্তাকে অভিন্ন কেন্দ্রে ধারণ করেছে। মাসুদ খান মৌন স্বভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ায় তার কবিতাপাঠ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে এইসব প্রশ্ন অনিবার্য করে তুলেছে। পৃথিবীর সকল কবি ও কবিতাপাঠক সবকালেই সমকালীন হতে চান, কিন্তু কবিতা চিরকালের বিষয়।
মানুষের আবেগ-প্রেম-অনুভূতি এগুলোই কবিতাকে চালিত করে। কবি নিজেকে সংবেদ ও আবেগহীন ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সেই ঘোষণাপত্র আবেগগত। মাসুদ খানের কবিতা থেকে আমরা সংবেদ ও আবেগের এই প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারি। ‘নদীকূলে করি বাস’ কবিতাগ্রন্থে যে বৃষ্টি, নিদ্রা ও প্রকৃতিযাপনের শব্দলোক নির্মাণ করেন তা পাঠক হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতার জগতে নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। কারণ কবি হিসেবে তিনি একটা অভিজ্ঞতালোক আর অভিজ্ঞতা সন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু থেকেই আবিষ্কার করেছিলেন। স্বাবলম্ব কবির শব্দ, উপমালোক, চিত্র ও চিত্রকল্প তাকে যে আলাদাভাবে চিহ্নিত করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ‘পাখিতীর্থদিনে’, ‘নদীকূলে করি বাস’ এবং ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’ কবিতাগ্রন্থে এ কারণেই কবিতার দূরত্ব যত সৃষ্টি হয়, আঙ্গিকের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আঙ্গিক যে কবিতাসাপেক্ষ একটি ধাঁচ, মাসুদ খানের কবিতাপাঠসূত্রে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি। মাসুদ খান তার কবিতাবিশ্বের অনুসন্ধানপর্বেই বোধের সম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু একজন কবির অভিজ্ঞতালোক সাধারণের অভিজ্ঞতার সমধর্মী নয়। চৈতন্যের ডালপালা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমীকৃত হয়ে কবিকে নিয়ে যায় রূপান্তরের পথে। মাসুদ খান সমসাময়িক কবিদের থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিস্বর সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন কেবল অস্তিত্বগত উপলব্ধির কারণে নয়, জীবনানুষঙ্গ, শব্দনির্বাচন এবং বিজ্ঞান ও পুরাণের যৌথায়নের পথ ধরে। অগ্রজ কবিদের কাব্যচারিত্র্য ও নন্দনচিন্তাকে অতিক্রম করে গেছেন তিনি কবিজীবনের শুরুতেই। এবং তিনি আত্মরূপান্তরের পথনির্মাণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সতর্ক। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘পাখিতীর্থদিনে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে, দ্বিতীয় কবিতার বই ‘নদীকূলে করি বাসে’র প্রকাশকাল ২০০১, ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’-এর প্রকাশকাল ২০০৬। প্রথম দুটি গ্রন্থের প্রকাশকালের ব্যবধান থেকেই কবির সতর্ক শিল্পচারিত্র্য অনুভব করা যায়। ‘নদীকূলে করি বাস’ থেকেই আমরা বুঝতে শুরু করি, মাসুদ খান যে জীবন নির্মাণ করেন তার কবিতায় সে জীবন আমাদের থেকে দূরবর্তী নয়। কিন্তু যে উপলব্ধি থেকে তিনি নির্মাণ করেন, তা একেবারেই নতুন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে:
১.
মেঘ থেকে মেঘে লাফ দেবার সময়
তুরীয় আহাদে দ্রুত কেঁপে-বেঁকে
একটানে একাকার যখন বিজলিসূত্র, ওই ঊর্ধ্বতন
মেঘের আসনে এক ঝলক দেখা গেল তাকে
আলোকিত ঘনকের আকারে।
[বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা, নদীকূলে করি বাস।]
২.
চন্দ্রলোক। ওই পিতৃস্থল থেকে প্রতিহত হয়ে
এক ক্ষিপ্র বারুদবিন্দুর যথা-উচিত গতিতে
বারবার সেই একই পিত্রায়ণপথে ভূপতিত হই
ভূপৃষ্ঠের বহু বাগানের সবজি বিভাগে বিভাগে,
রাশি-রাশি বাষ্প আর মহাকাশে
ভাসমান কত কোলাহল সহযোগে।
[চাঁদ, ঐ]
৩.
নিখিলের হঠাৎ-বিগড়ে-যাওয়া সে-কোন গোপন সংখ্যামেশিনের থেকে
অচেনা অসুখের মতো, অজ্ঞাত গজবের মতো গলগল করে
বেরিয়ে আসছে সব শূন্য।
[শূন্য, সরাইখানা ও হারানো মানুষ]
৪.
আস্তে আস্তে অন্ধ হয় সন্ধ্যাকালে চোখেরা আমার
আর দুর্নিবার হয়ে ওঠে ক্রমে তোমাকেই দেখবার বাসনা আবার।
[অন্ধ, ঐ]
৫.
আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে ফিরে
সমগ্র নীলিমা তছনছ করে দিয়ে
কোটি-কোটি দুষ্ট দাপুটে শিশু খেলছে হলুস্থুল বালিশ-ছোড়ার খেলা।
[ব্লিজার্ড, আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি]
৬.
বুড়িয়ে গিয়েছে সূর্য। দুরারোগ্য দেহ ফেটে বিকীর্ণ হচ্ছে প্রাণঘাতী সব রশ্মি।
ভয়ংকর ঝাপটা এসে লাগছে গ্রহে, গ্রহাণুপুঞ্জে।
প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছে মানুষ ও প্রাণিকুল।
[লোকান্তর, ঐ]
৭.
থেমে গেছে গুজবে-ভরা জঙ্গলের ফিসফিস-ধ্বনি।
তুখোড় তুফানে ঢেউয়ে-ঢেউয়ে মারমুখী যে-দরিয়া ছিল
এইখানে একদিন, সেও সরে গেছে দূরে।
যে-পাহাড় ছিল ঝরনা-ঝরানো
যে-পর্বত ছিল যুক্তাক্ষরে জটিল
ভোঁতা হয়ে মিশে গেছে তারা সমতলে।
[কবি, এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায়]
উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুচ্ছ মাসুদ খানের কবিস্বভাবের বহুস্তরিক বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করে দেয়। মেঘলোকের পরাবাস্তব চলচ্ছবি থেকে শুরু করে চন্দ্রলোকর ‘সংখ্যামেশিনের থেকে অচেনা অসুখ’ কিংবা ‘কোটি কোটি দুষ্ট দাপুটে শিশু’র বালিশখেলা নিঃসন্দেহে পাঠকের অভিজ্ঞতার জন্যে কবিতার সম্প্রসারিত ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। জীবনানন্দীয় শতাব্দী থেকে মানুষ এখন অনেকটাই অগ্রগামী বা দূরবর্তী, কিন্তু আকাশ নক্ষত্রলোক আর প্রকৃতির রূপ-রূপান্তরের চরিত্র অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। কবির চোখ জীবনানন্দীয় জগৎকেই যেন কখনো কখনো নতুন চোখে আবিষ্কার করে। আর সেখানে যোগ হয় অভিজ্ঞতার নতুন শস্যকণা, জীবনসূত্রে উঠে আসা অনিবার্য শব্দগুচ্ছ ‘বুড়িয়ে গিয়েছে সূর্য। দুরারোগ্য দেহ ফেটে বিকীর্ণ হচ্ছে প্রাণঘাতী সব রশ্মি।/ভয়ংকর ঝাপটা এসে লাগছে গ্রহে, গ্রহাণুপুঞ্জে।’—বিজ্ঞানানুষঙ্গের অনুপ্রবেশে জীবনানন্দীয় জগৎ আর অভিজ্ঞতালোক পরিবর্তিত হয়ে গেছে এখানে। মাসুদ খানের কবিতাযাত্রার পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে আমরা চিনে নিই এমন একজন কবিকে, অভিজ্ঞতার ভূমিতল থেকে চেতনার আকাশ পর্যন্ত যার বিচরণ। প্রতিমুহূর্তে নতুন করে জগৎ ও জীবনকে দেখা একজন কবিকে বারবার নিয়ে যায় আত্মরূপান্তরের পথে। সেই আত্মরূপান্তর মননসিদ্ধ হবে না আবেগ নির্ভর হবে সেটা নির্ধারণ করবেন কবি স্বয়ং।
মাসুদ খানের এ পর্যায়ের স্বপ্ন-সন্ধানের প্রকৃতি নিরূপণ করতে তার একটি কবিতার আশ্রয় নেয়া যেতে পারে—
এবার বলো হে ফিরতিপথের নাবিক,
ওহে মাথা-মুড়ে-ফেলা ভিনদেশি কাপ্তান,
সেই দ্বীপের খবর বলো
যেইখানে মানিপ্ল্যান্ট ও সোলার প্ল্যান্টের পাতারা
একযোগে চিয়ার্স-ধ্বনি তুলে পাল্লা দিয়ে
পান করে রোদের শ্যাম্পেন।
কোন প্রজন্মের উদ্দেশে তাদের সেই স্বতঃস্বাস্থ্যপান?
সেই দ্বীপদেশের কথা বলো যেখানে নারীরা
সামান্য একটি কাঠের কুটিরে
ফুটিয়ে তোলে অন্তত বাষট্টি রকমের বাৎসল্য ও প্রীতি।
[স্বপ্নভূভাগ]
প্রথম পর্যায়ের সার্বভৌম বিজ্ঞানমনস্কতা, মধ্যপর্যায়ের পরাবিদ্যার (Metaphysics) জগৎ থেকে কবির চোখ যে এখন ভিন্নতর বিষয়ের দিকে ধাবমান, উদ্ধৃত কবিতাংশ তার প্রমাণ। পাঠক কেবল তাকিয়ে থাকবে এক ধাবমান কবিপ্রকৃতির পানে।