ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে হাজারো মানুষ। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় লুটপাট চালায় সুযোগসন্ধানীরা। তারা অধিবেশনকক্ষের কনফারেন্স সিস্টেম (মাইক), লাইটসহ আসবাব লুট করে নিয়ে যায়। লুটপাট করে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপদের কক্ষসহ ৯ তলা ভবন এবং সংসদ সচিবালয়ের প্রায় সব কক্ষে। এগুলো এখন মেরামত করতে গিয়ে স্বল্পমেয়াদি কনফারেন্স সিস্টেম, তার, সকেট ও লাইট, স্ক্যানার, আর্চওয়েসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক উপকরণের জন্যই গুনতে হবে কমপক্ষে ৭৩ কোটি টাকা।
সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে একটি তালিকা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে টাকা অনুমোদন হয়ে এলে শুরু হবে মেরামতকাজ। গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, বিদেশি সাউন্ড সিস্টেমসহ কিছু উপকরণ একটু বেশি দামি হওয়ায় টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের (ই/এম বিভাগ-৭) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সংসদের অধিবেশনকক্ষ অচল অবস্থায় আছে। আমরা পুরো সংসদ ভবন এলাকার বিভিন্ন কাজের সংস্কারের জন্য ৭৩ কোটির মতো লাগবে। এর মধ্যে সাউন্ড সিস্টেমেই শুধু ২২ কোটি টাকা। টাকা পাস হয়ে এলে পরে দরপত্র হবে।’
পূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ব্লকের মেইন সার্ভিস লাইন, ক্ষতিগ্রস্ত সুইচ, সকেট, পয়েন্ট ওয়্যারিং, এলইডি লাইট, টিউবলাইট, সার্কিট ব্রেকার সরবরাহ ও পুনঃসংস্কারকরণে স্বল্পমেয়াদি খরচ ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। স্বল্পমেয়াদি রাস্তা, মাঠ, গেট, লেক, সি-রোডের ক্ষতিগ্রস্ত সিকিউরিটি লাইট, মেইন সার্ভিস লাইন, গ্যাপের ফোকাস লাইট, ফোকাস লাইট, স্ট্রিট লাইট, গার্ডেন লাইট, সার্কিট ব্রেকার পুনঃসংস্কারকরণের জন্য ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা; সিকিউরিটি গেট এবং পোস্টের মেটাল গেট, গার্ডেনের বৈদ্যুতিক সংস্কারের জন্য ৮৭ লাখ টাকা খরচ হবে। বিভিন্ন ব্লকের লিফটের ক্ষতিগ্রস্ত ও অকেজো যন্ত্রাংশ এবং এডিআর, সড়কবাতি ও ফ্লাড লাইট, সিসিটিভি পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজের জন্য খরচ হবে ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
এ ছাড়া সংসদ ভবনের সচিব হোস্টেল, এলডি হল, মেডিকেল সেন্টার, মিডিয়া সেন্টার, টিডি স্টুডিও, ব্যাংকের মেইন সার্ভিস লাইন, ক্ষতিগ্রস্ত সুইচ, সকেট, পয়েন্ট ওয়্যারিং, এলইডি লাইট, টিউবলাইট, সার্কিট ব্রেকারসহ বৈদ্যুতিক সংস্কারের জন্য ৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। সংসদ ভবনের এন এ সি, এইচ সি বাসা, সচিব ও যুগ্ম সচিব হোস্টেল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কোয়ার্টারের বাসার ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক স্থাপনার মেরামত ও বৈদ্যুতিক কাজের জন্য ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। সংসদের ভেতরে ক্ষতিগ্রস্ত প্লিট, উইন্ডো টাইপ এসি, স্ট্যান্ড ফ্যান পরিবর্তন ও মেরামতের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২১৯ কোটি টাকা। ভবনের নবম তলার সাব-স্টেশন, এমএমপি রুম, রিসেপশন, ওয়েটিং রুম, গণপূর্ত সার্কেল অফিসসহ মসজিদ-সংলগ্ন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অফিসের বৈদ্যুতিক কাজের জন্য ৯০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। সংসদ ভবনের ৬০০ আরটিএর ৫টি চিলার এবং ২৪টি এয়ার হ্যান্ডলিং ইউনিটের ক্ষতিগ্রস্ত ডিএফডি, ডি-বেস্ট, ডাক্ট, ম্যাগনেটিক সুইচ, ডাক্টের যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। সংসদ ভবনের গেট নম্বর ১, ৬, ৭, ১২ এর জন্য স্ক্যানার, আর্চওয়েসহ অন্যান্য সিকিউরিটি ডিভাইসের বৈদ্যুতিক সংস্কারের জন্য ৬ কোটি ১১ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
ভবনের প্ল্যানারি হলের ক্ষতিগ্রস্ত ও অকেজো কনফারেন্স সিস্টেম পরিবর্তন, কংগ্রেস টাইপ কনফারেন্স সিস্টেম সরবরাহ ও স্থাপন এবং বিভিন্ন কমিটি কক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত ও অকেজো কনফারেন্স সিস্টেম পরিবর্তন করে নতুন কনফারেন্স সিস্টেম সরবরাহ ও স্থাপনের জন্য ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে। ভবনের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, উচ্চমান আবাসিক ভবনের মোট ১০টি বাসার ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক স্থাপনার পরিবর্তন ও মেরামতের জন্য ২ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং এমপি হোস্টেলের মোট ১৯২টি রুমের মেইন সার্ভিস লাইন, ক্ষতিগ্রস্ত সুইচ, সকেট, পয়েন্ট ওয়্যারিং, এলইডি লাইট, টিউবলাইট, সার্কিট ব্রেকারের বৈদ্যুতিক সংস্করণের জন্য খরচ হচ্ছে ৬ কোটি ৮৩ লাখসহ মোট ৭৩ কোটি টাকা। এর বেশির ভাগ খরচের মন্তব্যে স্বল্পমেয়াদি লেখা আছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ৫ আগস্ট একদল লোক সংসদের অধিবেশনকক্ষে সংসদ নেতা, স্পিকার, সংসদ সদস্যদের চেয়ার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কার্যালয়, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও কর্মকর্তাদের অফিসের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর-তছনছ করে। তাঁদের বাসভবনও ভাঙচুর করা হয়। এ সময় তারা কম্পিউটার, আসবাবসহ সব জিনিস যেখানে যা পেয়েছে, সবই লুট করে নিয়ে গেছে। টেলিফোন লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে পুরো সংসদ ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।