কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে দ্রুত নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রজনতা ও রাজনীতির একটি অংশ বলছে যৌক্তিক সংস্কার, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের অপরাধ এবং চব্বিশের গণহত্যার বিচারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এমন পরিস্থিতিতে এ বছরের শেষ সপ্তাহে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের চূডান্ত রোডম্যাপ রয়েছে সরকারের। রাজনৈতিক দলসহ সকলে ঐকমত্যে পৌঁছলে ডিসেম্বরেই ভোট হবে।
নির্বাচন আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে চব্বিশের শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের মতামত। তারা যদি আপত্তি জানায় এবং ছাত্রজনতার নেতৃত্ব দানকারীরা যদি সম্মত না হয় তবে সরকারের পক্ষে নির্বাচনের আয়োজন কঠিন হয়ে যাবে। জানা গেছে, সরকার শীঘ্রই শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের কাছে ভোটের বিষয়ে জানতে চাইবে।
রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে চার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বাকিগুলো শীঘ্রই জমা দেবে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব শেষ হলেই নির্বাচনের রোডম্যাপে চলে যেতে পারবে সরকার। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তির মেয়াদ চলতি বছর শেষ হচ্ছে।
এর মধ্যে দু’একটি চুক্তি নবায়নে নির্বাচিত সরকারের অপরিহার্যতা রয়েছে। সকল কিছু মাথায় রেখে ড. ইউনূস সরকার ভোটের সকল আয়োজন সম্পন্ন করে রাখবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও বিপ্লবী ছাত্রজনতার চাওয়াকেও তিনি গুরুত্ব দেবেন। কারণ ছাত্রদের চাওয়ার মধ্যেই একটি বিজয়ের মধ্যে এই সরকার এসেছে।
ছাত্রদের বড় অংশ এখনো অনঢ় অবস্থানে রয়েছেন। তারা শেখ হাসিনাসহ যারা চব্বিশের গণহত্যার মদতদাতা তাদের বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ নির্বাচনে যেতে চান না। আগে বিচার হবে, দেশের মৌলিক বিষয়গুলো সংস্কার হবে, তারপর নির্বাচন হবে। ইতোমধ্যে শহীদ পরিবারের বড় অংশ সরকার এবং জুলাইয়ের ছাত্রনেতাদের জানিয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা শুধু নির্বাচনের জন্য জীবন দেয়নি। খুনিদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে কেউ নির্বাচনের পক্ষে মত দেয়নি।
ছাত্র জনতার আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশের আন্দোলনের অতীতের ধারাবাহিকতা এখন আর নেই। সাধারণ মানুষ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য গুলির সামনে দাঁড়াতে এখন মৃত্যুভয় ভুলে গেছেন। চব্বিশে প্রতিটি ঘর থেকে আন্দোলন হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে চলমান অস্থিরতায় দেখা গেছে, মানুষ খালি হাতে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন।
এই মানুষগুলো আসলে কোন উদ্দেশ্য দাঁড়াচ্ছে, সেগুলোও দেখতে হবে। চব্বিশের আন্দোলন কোনো ভোটের জন্য হয়নি। এটি এমন একটি আন্দোলন হয়েছে যা স্বৈরাচার থেকে মুক্তির আন্দোলন, অধিকার নিশ্চিতের আন্দোলন। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক কিংবা দু’একটি দেশের চাপে যদি সরকার ভোট দিয়ে দেন তাহলে দু’এক বছরের মধ্যে দেশে আবারও বড় ধরনের বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে যাবে।
তারা আশা করেন, বর্তমান সরকার একটি নিরাপদ বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার জন্য যা করা দরকার তাই করবেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সকল জটিলতায় সমাধান হলে এবং সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্রজনতা সবার মধ্যে ঐকমত্য হলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভোট হতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের বিপরীতমুখী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, ‘দুই দেশের পারস্পরিক সার্বিক সম্পর্ক তখনই স্বাভাবিক হবে, যখন সে দেশে (বাংলাদেশ) নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে।’ অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত মন্তব্য করবে না।’
একই সঙ্গে ভোটের সিদ্ধান্ত দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দল নেবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্যান্য দেশের কূটনৈতিকরা। ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস বলেন, ‘বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়।’ একই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের জন্য রাজনীতির একটা অংশও চাপ দিচ্ছে। তারা বলছেন, দ্রুত নির্বাচন না হলে দেশে অর্থনৈতিক সংকট ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি নবায়নে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রেমিটেন্স যোদ্ধারা ছাত্রজনতার সরকারকে সহযোগিতা করলে অনেক কিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিপ্লব পরবর্তী ছাত্রসমাজ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ভুল করে ফেলেছেন। এই সুযোগে সরকারের মধ্যে কয়েকটি ধাপে নানা প্রেসক্রিপশন ঢুকে পড়েছে। ছাত্রদের প্রভাব থেকে পুরো রাষ্ট্রকাঠামোকে আলাদা করতে এখানে অনেকগুলো স্তরে কাজ হচ্ছে। পরিপূর্ণ সফল সেটি এখনো বলা যাবে না। প্রায় দুই হাজার ছাত্রজনতা শহীদ এবং ২৫ হাজার পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিরা বিপ্লবের বড় ম্যান্ডেট।
আগামী অন্তত ২/৩ যুগ শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের চাওয়া চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়েই কাজ করতে হবে। যারা সেটির বিরুদ্ধে যাবেন তারা অল্প সময়ে ভেঙে পড়বেন। সে ক্ষেত্রে এখনো ছাত্রদের শক্তি বড় আকারে রয়েছে। এই ছাত্রদের সঙ্গে এখন কয়েকটি রাজনৈতিক দল, গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী শক্তির সমর্থন রয়েছে। তারা রাজনৈতিক দল গঠনেরও প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। সেটি হয়ে গেলে বিএনপি জামায়াত এবং ছাত্রদের অংশের পরিপূর্ণ ঐক্য ছাড়া নির্বাচনের ডেটলাইন ঠিক করতে পারবে না সরকার।
ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন হয়ে গেলে বড় দলগুলো যদি সমঝোতায় বসেন এবং শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি শক্তভাবে উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে ডিসেম্বরেই হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ ভোট।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে কবে নির্বাচন হবে তা এখনই বলা মুশকিল। নির্বাচন এ বছরের মধ্যে হবে, নাকি আগামী বছর হবে তা ধারণা করা যাচ্ছে না। তবে এইটুকু বলতে পারি সবার সম্মতিতেই আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। দেশের সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্রজনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত এবং দেশের জনগণের সম্মতি প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই সরকারের মৌলিক কাজ সংস্কার করা, সেগুলো গ্রহণযোগ্য বা বাস্তবায়ন করা।
তার ভিত্তিতে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে তখনই নির্বাচন হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনীতি বা নির্বাচন নিয়ে কি হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের এখনো অজানা। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাবরিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন সংস্কার এসব বিষয় নিয়ে এখন কথা বলাও মুশকিল। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটাও বলতে চাচ্ছি না।
বৈষম্যবিরোধীদের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা শুধু চারদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের বিষয়ে কথা শুনছি। নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা অবশ্যই সিদ্ধান্ত দেবে দুই হাজার শহীদ পরিবার এবং পঙ্গুত্ববরণ করা ২৫ হাজার মানুষ। অন্তর্বর্তী সরকার কবে কখন নির্বাচন দেবে সেখানে অবশ্যই শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের ম্যান্ডেট লাগবে।
প্রায় দুই হাজার শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিরা যখন নির্বাচন চাইবে তখনই নির্বাচন হতে পারে। আশা করছি অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করবেন। তাদের ম্যান্ডেট নিয়ে তারপরে নির্বাচন দেবেন।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, কয়েক মাস ধরে বলছি সামনে নির্বাচন। আপনারা যত সহজ ভাবছেন এত সহজ নয়। ভাবতে পারেন বিএনপির তো গ্রাম পর্যন্ত শাখা প্রশাখা রয়েছে। এত বড়াইয়ের কিছু নেই। আমাদের কাছে স্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে, জনগণ যখন ক্ষিপ্ত হয়, তখন কিভাবে স্বৈরাচারকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কেন চাইছি আমরা। একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া ম্যান্ডেড পাওয়া যায় না। সংস্কার করতে হলেও পার্লামেন্ট লাগবে। নির্বাচন যত দ্রুত হবে দেশের সংকট তত দ্রুত কাটবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকার যেন স্থায়ী সমাধানের জন্য অতিদ্রুত একটি নির্বাচন দেন’ আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। ভোটের পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দেশ সংস্কার করবে।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন, সেটা না হলে অতীতের মতো অস্বচ্ছ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নির্বাচন কমিশনের কিছু সংস্কার, সংবিধানে সংস্কার করা দরকার। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার সংলাপ করবেন।
এর পরই নির্বাচনে যেতে হবে। নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে এ জন্য তারা আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নির্বাচন চেয়েছেন। আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার চাই, তারপর নির্বাচন। তবে আমাদের একটা মৌলিক দাবি রয়েছে, সেটা হচ্ছে আগামী নির্বাচন অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, পনেরো বছরে যে যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোকে সমাধান করা আবশ্যক। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণ সম্ভব। সেটা আমরাও মনে করি, তবে সেটি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা ২৪ এ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসেছিল সকল ছাত্ররা বলছেন যৌক্তিক সময়ের পরে নির্বাচন।
যৌক্তিক সংস্কারগুলো ন্যূনতম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। ন্যূনতম স্বৈরাচার হাসিনার বিচার নিশ্চিত করা, নির্বাচন কেন্দ্রিক যে সংস্কারগুলো রয়েছে- মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এগুলো শেষ করে তারপর নির্বাচনের দিকে যাওয়া যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যে অপরাধগুলো করেছে সেগুলোর বিচার হওয়ার পর, গণহত্যার বিচার হওয়ার পর আলোচনা হতে পারে নির্বাচন কবে হবে। আমাদের হাতের মধ্যে যে ভাইদের মৃত্যু হয়েছে সেই হত্যাকা-ের বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে কোন স্পেস দিতে আমরা রাজি নই।