জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। এরমধ্যে ঢাকা ও ইসলামাবাদ; উভয়ের পক্ষ থেকেই আগ্রহও স্পষ্ট হওয়া গেছে। তবে ১৯৭১ সালে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এই দুই দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এখনও অমীমাংসিত। ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, সময় অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইসঙ্গে পুরনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুরও মীমাংসা প্রয়োজন। বিশেষ করে, স্বাধীনতার আগে দুই দেশের অর্থনৈতিক দেনা-পাওনার হিসাব, ঢাকায় আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রসঙ্গ এবং সেসময় দেশটির ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল ছিল। কূটনীতিতে ‘রাজনৈতিক যোগাযোগ’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি ছিল অত্যন্ত কম। ২০১০ সালে শেষ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং ২০১২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর ছাড়া তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ ছিল না। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ অর্থাৎ ভিসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতা, অশুল্ক বাণিজ্য বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতাও ছিল। মোটা দাগে শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া অন্যান্য যোগাযোগ ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ‘সৌজন্য বৈঠক’ হয়েছে। অক্টোবরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকটা আমাদেরও স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল।’
সম্প্রতি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের রাজনৈতিক বৈঠক এবং যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক করার জন্য প্রস্তাব এসেছে। ঢাকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের কার্যক্রম এখন আগের যেকোনও সময়ের থেকে অনেক বেশি দৃশ্যমান।
বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কূটনীতিকদের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা দরকার। তাদের মতে, ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা বাংলাদেশের ভূখণ্ড যেন অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়– সে বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কে কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু ভারতের জন্য সংবেদনশীল বিষয়গুলোর প্রতিও বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ঢাকা ও ইসলামাবাদ সম্পর্ককে শুধু দ্বিপক্ষীয় লেন্সে বিবেচনা করা হয়তো ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটিকেও বিবেচনায় নেওয়া সমীচীন হবে।
অতীতে বিভিন্ন সময়ের ঘটনাবলি যেমন— ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান বা জাল ভারতীয় রুপি ধরা পড়ার বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য; এসব বিষয় থেকে বাংলাদেশকে সাবধানে থাকতে হবে বলে মনে করেন সাবেক ওই কূটনীতিক।
তিনি বলেন, ‘কূটনীতিতে শুধু জাতীয় স্বার্থ কাজ করে। ঢাকার প্রতি দিল্লি বা ইসলামাবাদের বিশেষ কোনও আনুকূল্য বা সুনজর নেই। এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকার বোঝে। তবে বিষয়টি জনগণ যত বেশি ভালো বুঝবে, ততই মঙ্গল।’
ঢাকার অবস্থান
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঢাকার একটি শক্ত অবস্থান হচ্ছে – বাংলাদেশের ভূখণ্ড অন্য দেশের ক্ষতির জন্য ব্যবহার করতে না দেওয়া।
এ বিষয়ে সাবেক আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘ঢাকার অবস্থান পরিবর্তনের কোনও সুযোগ নেই। এ নীতির পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এ বিষয়ে সরকার নিশ্চয়ই অত্যন্ত সজাগ আছে।’
ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে পরিবর্তন
সম্প্রতি ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। ভিসা ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আগে পাকিস্তান থেকে আসা কনটেইনার ‘নিবিড় পরীক্ষা’ বন্ধ করে ‘সাধারণ পরীক্ষা’র ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘বাণিজ্য সম্প্রসারণ বা মানুষে-মানুষে যোগাযোগ দুই দেশের জন্য ইতিবাচক হবে। বর্তমান পৃথিবীতে যত বেশি যোগাযোগ তত বেশি দুই পক্ষের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
অমীমাংসিত ইস্যু
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা ও নির্যাতন করেছিল। একইসঙ্গে দুই দেশের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগির বিষয় ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘এই বিষয়গুলো- বিশেষ করে ১৯৭১ সালে গণহত্যার ঘটনায় ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মীমাংসা হওয়া দরকার।’
গত অক্টোবরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের কৃতকর্মের জন্য ওই দেশ ক্ষমা প্রার্থনা করলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সহজ হবে।’
এ বিষয়ে সাবেক ওই কূটনীতিক বলেন, ‘মানুষ বা দেশ ভুল করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভুল করেছিল– এ বিষয়টি ইসলামাবাদ যত দ্রুত স্বীকার করবে, তত দ্রুত দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও ভালো হবে।’