Homeদেশের গণমাধ্যমেমা তো মা-ই | সারা বাংলা

মা তো মা-ই | সারা বাংলা


বৃদ্ধ হয়ে গেছেন ছেলে। বাক প্রতিবন্ধী, নানা শারিরিক জটিলতায় আক্রান্ত। চোখেও ঠিকমতো দেখতে পান না। নিজে থেকে চলতে ফিরতে পারেন না। এই বয়সেও সকল কাজে তার মা-ই ভরসা। বৃদ্ধ ছেলেকেও তেমনি ছোট্ট বাচ্চার মতো করে বুকে আগলে রেখেছেন বৃদ্ধা মা কয়েদ ভানু। ছেলে যত অচলই হোক না কেনো তাকে শেষ পর্যন্ত আদর-যত্নে রাখতে চায় মাতৃ হৃদয়, মা তো মা-ই!

সংসারে একসময় সব ছিল কয়েদ ভানুর। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসার। কিন্তু স্বামী তাকে তালাক দিলে ছারখার হয়ে যায় সবকিছু। দেশ স্বাধীনের আগের কথা, স্বামী আলতাফ হোসেন তিন সন্তানসহ তালাক দেন কয়েদ ভানুকে।

 এরপর থেকেই পুরোপুরি সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন কয়েদ ভানু। দুই মেয়ে আর বাক প্রতিবন্ধী ছেলে আসকর আলীকে নিয়ে কয়েদ ভানু শুরু করেন সংগ্রামী জীবনের নতুন অধ্যায়। সেই সংগ্রামে সঙ্গী ছিল শুধুই দারিদ্রতা ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা। 

নিজের কোনো জমিজমা নেই বৃদ্ধা কয়েদ ভানুর। সে কারণে কখনো রাস্তার ধারের খুপরি ঘরে, কখনো মানুষের বাড়ির গোয়াল ঘরে, আবার কখনো ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় তিন সন্তান নিয়ে রাত কেটেছে জীবনের দীর্ঘ সময়। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন তিনি। 

বয়স হয়ে যাওয়ায় কেউ কাজেও নিতে চায়নি তাকে। বাধ্য হয়ে ভিক্ষাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে বয়সের ভারে একেবারেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন বৃদ্ধা কয়েদ ভানু। শরীর চলে না, তাই ভিক্ষাও করতে পারেন না। এরই মধ্যে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা নিজ স্বামীর বাড়িতেই থাকেন।

 এদিকে বাক প্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলে আসকর আলী বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধা মা কয়েদ ভানু ছাড়া তার দেখাশোনা করার মানুষও নেই। অথচ মায়ের সেবা করারই কথা ছিল সন্তানদের! 

এত দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছেলে আসকর আলীকে ছেড়ে যেতে পারেননি। এখনো পরম মমতায় বৃদ্ধ ছেলেকে বুকে আগলে রেখেছেন মমতাময়ী মা কয়েদ ভানু। দুঃখ-কষ্টের মাঝেই মা-ছেলের করুণ জীবন কাটছে। 

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি টিনের ঘরে মা কয়েদ ভানু ও তার অসুস্থ ছেলে কোনোমতে বসবাস করছেন। তীব্র শীতের সকালে একটু রোদের উষ্ণতার আশায় আঙিনায় স্তুপ করে রাখা খড়ের উপর পাশাপাশি বসে ছেলেকে ধরে রেখেছেন মা। মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে বসে আছেন জীর্ণ-শীর্ণ বৃদ্ধ ছেলে আসকর আলী। 

এ প্রতিবেদককে কিছু বলতে পারেননি বাক প্রতিবন্ধী আসকর আলী। কিন্তু চেষ্টা করেছেন খুব। তবে জীবনের প্রতি পাহাড় সমান অভিযোগ নিয়ে আনমনেই হাজারো কথা বলে গেছেন শারিরীক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কয়েদ ভানু।

কথা বলার সময় বারবার কেঁপে ওঠছিল তার ঠোঁট আর চোখের পাতা। হয়তো, জীবনে ঘটে যাওয়া বিষাদের গল্লগুলো গুছিয়ে বলার আগেই অন্তরের অগল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলো বারবার।

প্রতিবেশি আফসার হোসেন জানান, দীর্ঘ দিনেও প্রতিবন্ধী এই মা-ছেলের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সহযোগিতাও ভাগ্যে জোটেনি তাদের। গৃহহীন, ভূমিহীন মা-ছেলের পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে আসেননি। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধী ছেলেকে তার মা-ই দেখাশোনা ও সেবাযত্ন করে এসেছেন। 

তিনি বলেন, “সরকারের এত সামাজিক সেবা ছিল, অথচ প্রায় আশি বছর বয়সী একজন অসহায় বৃদ্ধার বয়স্ক ভাতা হয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতাও জোটেনি আসকর আলীর কপালে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে গৃহহীন, ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্লের ঘর পাওয়ার তাদের অধিকার ছিল। অথচ সেই ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দাতেই মা-ছেলের বহু রাত কেটেছে অর্ধাহারে, অনাহারে।” 

তিনি আরও বলেন, “গত বছর কনকনে শীতে কাগজ গায়ে দিয়ে মা-ছেলে ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় শুয়ে শীতে কাঁপছিলেন। আমরা গরম কাপড় এনে দিয়েছি। অথচ হতভাগ্য এই মা-ছেলেকে একটা কম্বলও দেয়নি ইউপি চেয়ারম্যান বা মেম্বাররা।” 

দুই বছর আগে কয়েদ ভানুর ভাগ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে। মা-ছেলেকে আশ্রয় ও তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কিছু তরুণ। 

এলাকার তামিম মিডিয়া নামের একটি সংগঠনের কয়েকজন যুবকের সহযোগিতায় মা-ছেলের দুজনের মধ্যে ছেলের নামে সম্প্রতি একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড হয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধা মায়ের নামে এখনো বয়স্ক ভাতার কার্ড হয়নি।

তামিম মিডিয়ার উদ্যেক্তা ও তরুণ সমাজকর্মী তরিকুল ইসলাম তামিম বলেন, “দুই বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী মা ও ছেলে কতদিন আগে তৃপ্তিসহকারে ভালো খাবার খেয়েছেন, তারা সেটা বলতে পারেন না। তাদেরকে সরকারি খাস জমিতে আশ্রয়নের একটি ঘরও দেওয়া হয়নি। তাদেরকে আমরা দুই বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দা থেকে এনে আশ্রয় দিয়েছি। খাবার এবং চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বর্তমানে থাকার এবং খাবার নিশ্চয়তা দেওয়া গেলেও, তাদের দুজনেরই উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।” 

বৃদ্ধা মা ও ছেলের জন্য তরিকুল ইসলাম তামিম ছাড়াও রব্বানী শেখ, মামুন মিয়া, জাকারিয়া রহমান দুলাল, মোস্তফা মন্ডল, আহসান হাবীবরাও স্বেচ্ছাসেবী ও ডোনার হিসেবে কাজ করছেন। 

তাদের ভাষ্য, আলোকিত সমাজের পাশাপাশি আলোকিত মানুষ গড়ে তুলতে চান তারা। অসহায় মানুষের জন্য কাজ করেন। এক বছর আগে অন্যের জমিতে ঘর তুলে দিয়েছিলেন মা-ছেলের জন্য। কিন্তু সেখান থেকেও তাদের তুলে দেওয়া হয়। এখন তামিম তাদের নিজস্ব জায়গায় একটি টিনের ঘর করে দিয়েছেন। সেখানে ঘরের সঙ্গেই টিউবওয়েল, পানির পাত্র ও ল্যাট্রিন করে দেওয়া হয়েছে।

কিশোরগাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, “বিগত ১৫ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা এই মা-ছেলের জন্য কিছুই করেননি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।” 

পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, “বৃদ্ধ মা-ছেলেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। বৃদ্ধা কয়েদ ভানুর জন্য জরুরি ভিত্তিতে বয়স্কভাতার কার্ড করে দেওয়া হবে। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি বৃদ্ধ ওই মা ছেলের পরিচর্যার জন্য সপ্তাহের তিনদিন সেখানে নার্স পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।”

জীবন সায়াহ্নে এসেও সন্তানকে স্নেহপাশে বেঁধে রাখা এই মা ও মায়ের স্নেহ ধারা আশ্রয়ে আশ্রিত বৃদ্ধ ছেলে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। কোনোমতে বেঁচে থাকা দুটো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কী খুব এমন কঠিন কাজ। সকলের সামান্য সহযোগীতাও তাদের জন্য অ।নেক বড় হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন শুধু হৃদয় ভরা মমতার।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত