Homeদেশের গণমাধ্যমে‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’


হঠাৎ করেই রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী আর্চার দম্পতি আলোচনায়। কাউকে না জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়ে চারদিকে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। আর্চারিতে এখনও অনেক কিছু দেওয়ার থাকলেও মাঝপথে দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে অর্থ অভাবকে কেউ কেউ বড় করে দেখছেন। ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতে আর্থিক ভিত্তি সেভাবে নেই- বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে। এ নিয়ে রোমান কিংবা দিয়া আসলে কী বলছেন? আসলেই কি দেশ ছাড়ার প্রধান কারণ আর্থিক ভিত্তি নাকি অন্য কিছু!রোমান এ নিয়ে কিছু বলতে না চাইলেও আর্চারির পোস্টার গার্ল হয়ে ওঠা ২১ বছর বয়সী দিয়া কিন্তু বাংলা ট্রিবিউনের কাছে অর্গল খুলে দিয়েছেন। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় গভীর রাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলাপচারিতায় দেশ ছাড়ার নানান কারণও বেরিয়ে এলো তাতে।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রথমেই জানতে চাইছি হঠাৎ ফেডারেশন কিংবা কাউকে না বলে নীরবে দেশ ছাড়লেন কেন? শুধুই কী আর্থিক কারণ নাকি অন্য কিছু?

দিয়া সিদ্দিকী: আমার বেলাতে বলবো আর্থিক কারণ বড় বিষয় ছিল না, আমি আসলে টঙ্গীতে জাতীয় দলের আবাসিক ক্যাম্পে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সবকিছু সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। কিছুতেই আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। তাই বুঝে শুনেই আর্চারি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেছি। আর ফেডারেশনকে বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আমি তো ছুটিতেই ছিলাম।

অনেকেই বলছেন আপনাদের আর আর্চারিতে দেওয়ার কিছু নেই। তাই উন্নত জীবন খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন… 

দিয়া: যারাই বলেছে না জেনেই বলেছে। এটা ঠিক, উন্নত জীবনের জন্য আর্চারি ছেড়ে  যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। কিন্তু আসার পেছনে অনেক কারণও আছে।  পারফরম্যান্স নেই এটা ঠিক নয়। আমাদের আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। কিন্তু হলো না।

এমন কী হয়েছে যে আপনি আর মানিয়ে নিতে পারছিলেন না?

দিয়া: তাহলে বিষয়টি খুলেই বলি। আমি সেখানে মানসিক টর্চারের শিকার হচ্ছিলাম। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ওটা একটা টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে, তাই বাধ্য হয়ে আগেই ভিসা থাকায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

আমরা তো জানি টঙ্গীর জাতীয় দলের ক্যাম্প সুখী পরিবার..

দিয়া: বাইরে থেকে দেখলে তেমনই মনে হয়। আমার বেলাতে মোটেও তা ছিল না। সবসময় মানসিক টর্চারের সম্মুখীন ছিলাম। ওরা আমাকে আর রোমানকে নিয়ে বেশি আলোচনা করতো। আমাদের নিয়েই ওদের যত আগ্রহ। এমনও হয়েছে, আমি বিবাহিত তারপরও  অন্য আর্চারকে জড়িয়ে আড়ালে আবডালে কটু কথা বলা হতো। আমাকে নানানভাবে বিরক্ত করা হতো। এমনকি অসুস্থ থাকলেও রুমে খাবার পর্যন্ত নিতে দেওয়া হতো না। নানানভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করতো। এভাবে কতদিন থাকা যায় বলুন?

কেন এমন করা হতো বলে মনে হয় আপনার?

দিয়া: কারণ একটা, ওদের আমি পাত্তা দিতাম না, পা চাটতাম না। ওদের রঙ্গ মঞ্চে ছিলাম না তাই। কোচ মার্টিন ফ্রেডরিককে বলে ছুটি নেওয়াসহ সবকিছু করতাম। কিন্তু শুধু ফ্রেডরিক কেন, ওদের কাছে থেকে অনুমতি কেন নেই না, এটা ওদের কাছে ভালো মনে হয়নি। ওরা তাই আমাকে নানানভাবে মানসিকভাবে টর্চার করতো। (দিয়ার পাশ থেকে রোমান বলে উঠেন ওদের যদি এতই ভালো হতো, তাহলে আমাদের খোঁজ খবর নিতে মন চাইতো। সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতো। অন্যদের মাধ্যমে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।)

এসব কথা ফেডারেশন কিংবা ফ্রেডরিককে বলেছিলেন?

দিয়া: হ্যাঁ, ট্রেনিং কমিটর ফারুক ঢালী স্যার ও ফ্রেডরিকের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম। বলার পর মাঝে মধ্যে পরিস্থিতি ভালো হতো। তবে উনারা তো কেউ ক্যাম্পে থাকতেন না। তাই সমস্যাটা বেশি দেখা দেয়। যখন উনারা থাকেন তখন সমস্যা কমই হতো। আর ফ্রেডরিকের নিজের তো সীমাবদ্ধতা আছে। বয়স হয়েছে। উনি যতটুকু পেরেছেন করেছেন। আসলে এভাবে কতদিন বলুন। তাই দেশ ছাড়তে অনেকটাই বাধ্য হয়েছি।

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর। তারা কারা?

দিয়া: তাদের টঙ্গীর ক্যাম্পে সবাই চিনেন জানেন। তারা ক্যাম্পের স্থানীয় কোচ। তবে আমি তাদের নাম বলতে চাই না। এর আগে রোমানের বেলাতেও তেমনই হয়েছে। ওকে নানানভাবে মানসিক যন্ত্রনা দেওয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন স্যারকে বিষয়টি খুলে জানিয়েছি।

আপনি যেসব অভিযোগ তুলেছেন প্রমাণ দিতে পারবেন? আর আরও আগেই কেন পুরো বিষয়টি নিয়ে চপল সাহেবেকে জানালেন না?

দিয়া: দেখুন প্রমাণের বিষয় এখানে আমি বিস্তারিত বলবো না। যা বলার চপল স্যারকে বলেছি। প্রয়োজনে সবকিছু দেখাতে পারবো। আর ওখানে তো সিসি ক্যামেরা আছে, কেউ ইচ্ছে করলেই তদন্ত করে দেখতে পারে। চপল স্যারকে আগে নানান কারণে বলা হয়নি। তখন মানসিক অবস্থাও সেভাবে ভালো ছিল না। এখন নিউজার্সি থেকে সব খুলে বলার পর চপল স্যার বলেছেন বিষয়টি দেখবেন। যেন যারা ক্যাম্পে আছেন তাদের বেলাতে এমন কিছু না হয়।

বলা হচ্ছে রোমান সানার ‘চাপাচাপিতে’ আপনি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টি আসলে কতটুকু সত্যি?

দিয়া: আমি তো  ‘খুকি নই’। আমার তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বয়স হয়েছে। ও কেন আমাকে প্রভাবিত করবে। দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটা আমাদের সম্মিলিত। এখানে অন্য কিছু ভাববার অবকাশ নেই।

রোমান তো আগেই জাতীয় দলে নেই। আপনার পারফরম্যান্স তো খারাপের দিকে ছিল। এটাও কি দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ?

দিয়া: তা হবে কেন। রোমানকে তো ফেডারেশন সুযোগই দিল না। ও কতবার বলেছিল এক মাস ট্রেনিংয়ের সুযোগ করে দিতে। তাহলেই আগের ফর্মে ফিরতে পারবে। কিন্তু নিয়মের গ্যাড়াকলে পড়ে তা হয়নি। আর আমি তো চোট নিয়ে টানা খেলে পদক জিতে আসছিলাম। এবার চোটের কারণে পারফরম্যান্স কিছুটা হেরফের হয়েছে। তবে আমার জায়গায় যারা খেলেছে তারা কেন পদক জিততে পারেনি। এটা তো কেউ বলছে না।

রোমান তো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পেছনে আর্থিক কারণটাকে সামনে নিয়ে এসেছেন…

দিয়া: ও কি শুধু নিজেরটা বলেছে নাকি। ও তো সামগ্রিক আর্চারদের কথা বলেছে। একজন আর্চার যদি জাতীয় দলে ক্যাম্পে তিন হাজার টাকা বেতন পান তাহলে সে চলবে কী করে… একবার কেউ ভেবে দেখেছে? ও আর্চারদের মানোন্নয়নের কথাই বারবার বলে আসছিল। যা অনেকেই ভালো চোখে নিতে পারেনি।

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

রোমানকে তো ভবিষ্যতে কোচ করার চিন্তা ভাবনা চলছিল… কিন্তু তিনি নাকি কোচিং কোর্সই করতে চাইছিলেন না..

দিয়া: আমার মনে হয় না ওকে ভবিষ্যতের জন্য কেউ কোচ পদে দেখতে চাইছিল। যদি সত্যি চাইতো তাহলে ওকে কোচিং কোর্স করতে দিতো। আর ও শুধু বিয়ের সময় কোচিং কোর্স করতে চায়নি। নতুন বউকে সময় দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে যখন চেয়েছিল তখন আর ওর নামই রাখা হয়নি। কারা জানি কেটে দেয়!

ফেডারেশন বলছে রোমান ক্যারিয়ার শুরুর পর ৪৬ ও আপনি ২৩ লাখ টাকা পেয়েছেন। এছাড়া সেই টাকা দিয়ে রোমান খুলনাতে চার তলা বাড়িও বানিয়েছেন! এটা কি যথেষ্ট নয়?

দিয়া: এই টাকা কি আমরা একসঙ্গে পেয়েছি বলুন। সবার পরিবার আছে। যা পেয়েছি তা দিয়ে পরিবার চলেছে। চিকিৎসাসহ অন্য কিছুও। শুধু আপনাকে বলছি রোমানের স্কিনে সমস্যা রয়েছে। যার একবার চিকিৎসা নিতে ১৬ হাজার টাকা লাগতো। কেউ যদি বলে খুলনাতে বাড়ি করেছে ও, তা মিথ্যা। আপনারা সেখানে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। যা আয় করা হয় তার খরচও তেমন।

গত সরকারের শেষ সময়ে সাফজয়ী শুটার শারমিন আক্তার ও দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার ফ্লাট কেনার মতো আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন। আর আপনারা তো দুজনেই আর্চারির বড় মুখ, অলিম্পিয়ান। অনেক পদকও দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন। আপনারা কেন দেশে স্থায়ী বসবাসের জন্য কিছু পাননি। ফেডারেশনের সঙ্গে তো গত সরকারের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর ভালো সম্পর্ক ছিল বলে জানতাম।

দিয়া: এটা ফেডারেশন ভালো বলতে পারবে। আমরা যারা দেশের জন্য পদক নিয়ে এসেছিলাম, কেন তাদের জন্য স্থায়ী কিছু করে দেওয়া হয়নি। দেশে যদি স্থায়ী ভিত্তি থাকতো তাহলে হয়তো রোমান বিদেশে থিতু হতে অনেক চিন্তা করতো। আমার বেলাতে আরও ভাবতে হতো।

আপনারা চলে যাওয়ার পর তো জাতীয় দলের আর্চারদের বেতন ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে শোনা গেছে।

দিয়া: যদি নেওয়া হয় তাহলে ভালো। পাশাপাশি ক্যাম্পের পরিবেশও ভালো করতে হবে। আমার আগে অন্য সিনিয়র আর্চারদের বেলাতেও বৈষম্য হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ মানসিক টর্চার সহ্য করেছে। এসব দূর করতে হবে।

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে অসীম কুমার পথ দেখালেন। হাকিম আহমেদ রুবেলের পর আপনারা দুজন..

দিয়া: কিছু করার ছিল না। বাধ্য হয়ে এসেছি। তবে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা যদি দূর করা যায় তাহলে আমার মনে হয় সামনে এমনটি হবে না।

আর্চারি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন। আর কখনও তীর ধনুক হাতে নেওয়া হবে না। লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চড়ানো হবে না… ভাবতে একটুও খারাপ লাগছে না?

দিয়া: খারাপ তো লাগছেই। দেশের জন্য খেলতে পারবো না। কিন্তু কিছু করার নেই। নিউ জার্সিতে এসেছি। ভাইয়ের বাসায়। এখানে এসে টুকটাক কাজের সন্ধান করছি। কীভাবে এখানে স্থায়ী হবো সেই চিন্তায় আছি। ভিসার মেয়াদও আছে অনেক দিন। আমাদের বেলাতে আর্চারি এখন অতীত হয়ে গেছে অনেকটা।

আপনি আর্চারির মাধ্যমে ও মেধা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন। পড়াশোনাটাও তো গেলো তাহলে!

দিয়া: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়ার সুযোগ থাকবে না। এটা ভেবেই অনেক খারাপ লাগছে। কতো স্মৃতি সেখানে। তবে আমি দিয়া সিদ্দিকী নিউ জার্সিতে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবো। এটা আমার প্রতিজ্ঞা। পড়াশোনা আমি কিছুতেই বাদ দেবো না। রোমানও চাইছে আমি যেন পড়াশোনা শেষ করি। তা যেভাবেই হোক না কেন।

‘ওটা একটা টর্চার সেল, বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছি’

আমরা শেষ দিকে এসে পড়েছি। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোয় বাবা-মা সতীর্থদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল…

দিয়া: আমার বাবা তো আগেই চেয়েছিল আমাকে জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাবেন। চপল স্যারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। উনি চাইতেন না উনার মেয়ে দিনের পর দিন মানসিক টর্চারের সম্মুখীন হন। এখন উনারা অনেক খুশি। অন্তত আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ভালো আছি। এখানে অন্তত কেউ বিরক্ত করার কেউ নেই। নতুন করে জীবন সাজাতে পারবো।

আপনার আর কিছু বলার আছে…

দিয়া: দেশে যারা অন্তত সাফল্য বয়ে আনে তাদের বিষয়টা সবার দেখা উচিত। জাতীয় দলের ক্যাম্পের পরিবেশটা ভালো হওয়া উচিত। আর্থিক ভিত্তি থেকে শুরু করে সবকিছু। এসব পরিবর্তন হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেখেও ভালো লাগবে। আর আর্চারি ছেড়ে আমরা চলে এসেছি। তবে চাই খেলাটা আরও এগিয়ে যাক। আমাদের জায়গায় নতুনরা আসুক।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত