আস্তুরিয়াসের পুরো নাম মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াস রোজালেস (Miguel Angel Asturias Rosales)। জন্ম গুয়াতেমালায়। লাতিন আমেরিকার যে-সকল লেখকের নাম আমাদের দেশে বহুল উচ্চারিত তাদের মধ্যে তিনি খুব একটা পড়েন না, যদিও লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক হিসেবে তিনি দ্বিতীয় জন। লাতিন আমেরিকায় তার পূর্বে একমাত্র নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক ছিলেন চিলির কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। মিস্ত্রাল বয়সে আস্তুরিয়াসের চেয়ে ১০ বছরের বড় ছিলেন বিধায় নোবেল জয় তার আগে হবে এমনটাই স্বাভাবিক। অবশ্য নোবেল পুরস্কার লেখকের বড়ত্বের জন্য বড় কোনো দলিল নয়। বোর্হেস কিংবা রুলফো নোবেলজয়ী না হয়েও লাতিন আমেরিকায় সকল সাহিত্যিকের শিরোমণি বা মাথার তাজ হিসেবে বিবেচ্য।
বোর্হেসের নাম উচ্চারিত হওয়ায় আরেকটি কাকতালীয় ঘটনা বলার যোগ্য হয়ে উঠলো। বোর্হেসের আর আস্তুরিয়াসের জন্ম একই সালে। সালটি ১৮৯৯। সাহিত্যের ইতিহাসে এই সালটির মোজেজাই একটু অন্য রকম। আমাদের জীবনানন্দ ও নজরুল দুজনেরই এই সালে জন্ম। আমেরিকার আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্মও এই সালে। জাপানের নোবেল বিজয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার জন্মও এই একই সালে। শতক-সংক্রান্তির এই সালে দিকে দিকে সাহিত্যের আন্দোলনে সংক্রান্তি ঘোষণার লেখকরাও যেন আয়োজন করে জন্মলাভ করেছেন। আস্তুরিয়াস লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যে-সংক্রান্তি ঘোষণার আয়োজন করেছিলেন অর্থাৎ যে বাঁকবদলের কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন তা-ও এমন ভাবনার সত্যতা প্রতিপাদন করে।
আস্তুরিয়াসের যে সালে জন্ম তার আগের বছর গুয়াতেমালার ইতিহাসের কঠিনতম একনায়ক এস্ত্রাদা কাবরেরা গুয়াতেমালার ক্ষমতা দখল করে। কঠিন এক স্বৈরশাসকের অধীনে জীবন কেমন হয় তিনি সেই ছোটবেলা থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছেন। কাবরেরা ১৯২০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে আস্তুরিয়াসের পিতা Ernesto Asturias Girón কাবরেরার হাতে অনেক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। আবার ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইউনাইটেড ফুট কোম্পানির চক্রান্তে ইয়াকোবো আরবেনৎসের (Jacobo Arbenz) পতন হলে কান্তিয়ো আরমাস লেখক আগুরিয়াসের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। পারিবারিক জীবনের এই অত্যাচার নির্যাতনের ইতিহাস এবং ঔপনিবেশিক আমলের ইউরোপিয় নির্যাতক গোষ্ঠীর হাতে গুয়াতেমালার আদিবসীদের নির্যাতনের ইতিহাস একত্রে আস্তুরিয়াসের সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেই বিষয়বস্তু প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সমসাময়িক সাহিত্যধারা তার জন্য যথেষ্ট যোগ্য ও উপযুক্ত মনে হলো না। তাই তিনি নিজে ১৮৯৯ সালে জন্মের মাধ্যমে শতাব্দীর বাঁকবদলের যেমন সাক্ষী হলেন, তেমনি লাতিন আমেরিকার এই দ্বিমুখী অত্যাচারের প্রকাশমাধ্যম হিসেবে সাহিত্যধারায় বাঁকবদলেরও এক অবিস্মরণীয় স্রষ্টা রূপে আবির্ভূত হলেন।
আন্তরিয়াস গুয়াতেমালা থেকে আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯২৩ সালে ইউরোপ গমন করেন। ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এথনোলজিতে অধ্যয়ন করেন। এই সময় আঁদ্রে ব্রেতোঁর সাথে তার সখ্য হয় এবং তিনি পরাবাস্তববাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। উপন্যাসের বাঁকবদলে তার নিজ দেশের ‘পোপোল বু’র ঐতিহ্য, নিজ দেশের বাস্তবতার বারোক রূপ আর ভিনদেশের মস্তিষ্কচির্চত বাস্তবতার সুররিয়ালিজম কীভাবে ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়ে নতুন নির্মাণের পথে যাওয়া যায় ফ্রান্সের দশ বছরের প্রবাসকালে তা-ই ছিল তার সৃষ্টিসত্তার নিরন্তর সাধনা ও আরাধনা।
প্যারিসের প্রবাসকালে তার প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিন Tiempos Nuevos বা ইংরেজি অনুবাদে New Times এই সাধনার সাক্ষী। এই সাধনার প্রথম প্রয়াস প্যারিসেই প্রসব করে আস্তুরিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘লিয়েন্দাস দে গুয়াতেমালা’ (Leyendas de Guatemala) ইংরেজি অনুবাদে Legends of Guatemala। এটি উপন্যাস নাকি গল্পগ্রন্থ তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। এই যে রূপের অনির্ণেয়তা এটিও কিন্তু আস্তুরিয়াসের হাতে উপন্যাসের বাঁকবদলের ছোটখাটো প্রমাণক।
Legends of Guatemala গ্রন্থে আটটি গল্প রয়েছে। আটটি গল্পই গঠনে মিথিকাল এবং অর্থে পলিটিকাল। এর মধ্যে শেষ গল্পটি আবার গল্প নয় বরং নাটক। আটটি গল্পেরই মূল চরিত্র গুয়াতেমালা, তবে স্বনামে নয়। এভাবে কয়েকটি পুরাণগন্ধী গল্প ও একটি নাটককে একত্র করে এক মলাটে ঢুকিয়ে দাবি করা যে এটি একটি উপন্যাস—এমন ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই উপন্যাসের সমসাময়িক চলতি ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং একটি বাঁকবদলের ঘোষণা পরোক্ষে উচ্চারিত হয়েছিল। উপন্যাসটি ১৯৩০ সালে প্যারিসে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৩২ সালে তিনি ফরাসিতে অনুবাদ করেন। এই অনূদিত Leyendas de Guatemala গ্রন্থের জন্য ঐ বছরই তিনি Sylla Monsegur পুরস্কার লাভ করেন। এমনকি সাহিত্যসমালোচক Francisco Solares-Larrave এ বই সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, লাতিন আমেরিকার দুনিয়াজোড়া খ্যাতির জাদুবাস্তবতার বীজ মূলত এই গ্রন্থেই প্রথম উপ্ত হয়েছিল।
আস্তুরিয়াসের এই বাঁকবদলের যাত্রা সূচনাতেই এমন কদর লাভ করলেও আপন দেশ গুয়াতেমালা বা পার্শ্ববর্তী স্প্যানিশ ভাষাভাষী অন্যান্য দেশে কিন্তু এ বাঁকবদলের দিকে কারো নজরই পড়ে না। ১৯৩৩ সালে তিনি লিখে সমাপ্ত করেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দি প্রেসিডেন্ট (El Señor Presidente)। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বইটি ছাপানোর জন্য কোনো প্রকাশই তার ভাগ্যে জোটেনি। শেষে ১৯৪৬ সালে তা প্রকাশ করতে পারেন, তা-ও নিজ দেশে নয়, বরং মেক্সিকোর এক অখ্যাত প্রকাশক প্রথম ছাপে। সাহস করে ছেপে প্রকাশককে দুর্ভাগ্যেই পড়তে হয়েছিল। বেশির ভাগ কপি গুদামঘরেই শেষ হয়, নষ্ট হয়, ক্রেতা জোটে না। উপন্যাসের বাঁকবদলের ক্ষেত্রে আস্তুরিয়াসের সবচেয়ে সাহসী শৈলীর উপন্যাসটি ছিল Hombres de maiz, ইংরেজি অনুবাদে Men of Maize। এটিও নিজ দেশে নয় বরং বাইরের দেশে, আর্জেন্টিনার শহর বুয়েনোস আয়ারসে ১৯৪৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি আর বাঁক বদলের নয়, বরং নতুন বাঁকে উঠে গিয়ে পেছনের বাঁককে বিদায় জানানোর লাতিন আমেরিকান প্রথম উপন্যাস। লাতিন আমেরিকার দুনিয়া কাঁপানো শৈলী জাদুবাস্তবতারও প্রথম নজির স্প্যানিশ ভাষায়। এই বাঁকে উপন্যাস সৃজনে আস্তুরিয়াস কথাশিল্পের ভাষা ও বাস্তবতা নিয়ে যত নতুনত্ব এবং যত চমক প্রদর্শন করেছেন—আমরা কি এখনো উপন্যাসের পাঠক হিসেবে সেই বাঁকে পৌঁছতে পেরেছি? কতটা পারছি তা এক ঝলক দেখে নিতে চলুন তার Men of Maize উপন্যাসের প্রথম কয়েকটি অনুচ্ছেদ আমরা একটু পড়ে দেখি।
‘গ্যাসপার ইলোম তাদেরকে ইলোমের জমি থেকে এর ঘুমটুকু কেড়ে নিতে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে…..
গ্যাসপার ইলোম তাদেরকে ইলোমের জমির চোখের পাতাগুলো কুঠার দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে….
গ্যাসপার ইলোম তাদেরকে ইলোমের জমির চোখের পক্ষ্মগুচ্ছের শাখাপ্রশাখাগুলো এমন আগুন দিয়ে পোড়াতে অনুমতি দিয়েছে যা চাঁদকে পুড়িয়ে বুড়ো পিপীলিকার রঙের কয়লা বানিয়ে দেয়…’
‘গ্যাসপার ইলোম তার মাথা এক পাশ থেকে আরেক পাশ করলো ‘না’ বলতে। মেদিনীর এ অভিযোগ অস্বীকার করতে সে ঘুমুচ্ছিল তার মাদুরে তার ছায়ার সাথে, তার বৌয়ের সাথে, তার মরদেহ আর নাভির সাথে মায়ের পেটের বন্ধনী রজ্জুকে কবরে রেখে, যেহেতু তার পক্ষে সম্ভব ছিল না সেই সাপের কুণ্ডলী থেকে বের হয়ে আসার যে সাপের কুণ্ডলীতে ছয়শত প্যাঁচ ছিল আর সেই প্যাঁচ তৈরি হয়েছিল কাদামাটি, গাছপালা, বৃষ্টি, চাঁদ, গিরিশৃঙ্গ, পাহাড়, পাখি, হ্রদ আর বজ্রপাত দিয়ে, আর সে অনুভব করছিল এই সবই তার শরীরকে নির্দয়ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে।
‘মাটিরা পড়ছে আকাশের নক্ষত্র থেকে স্বপ্ন দেখেতে দেখতে, তারপর জেগে উঠছে পাহাড়ে পাহাড়ে, যেখানে জেগে আছে ইলোমের কেশশূন্য শৈলশিরা। যেখানে গার্দিয়া পাখিরা গান গাইছে পাতালের গহ্বরে পানি প্রবেশের মতো গর্জনের দীর্ঘশ্বাসে, বাজপাখি ডানা মেলছে সেই শৈলশিরার ওপরে, উইপোকারা হাঁটছে, ঘুঘুরা কাঁদছে, আর সে ঘুমুচ্ছে তার মাদুরে, তার ছায়ার সাথে আর বৌয়ের সাথে, এমন একজনের মতো যার উচিত তাদের চোখের পাতাগুলো কর্তন করে দেয়া যারা বৃক্ষগুলো কুঠারের আঘাতে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, যার উচিত তাদের চোখের পক্ষ্মগুচ্ছ পুড়িয়ে দেয়া যারা জমিকে পুড়ছে, যার উচিত তাদের শরীরগুলো ঠাণ্ডায় জমিয়ে দেয়া যারা নদীর পানি ধরে রাখে যে নদী স্বপ্ন দেখে দেখে প্রবাহিত হয় অথচ তাদের থাবায় পড়ে আটকে যায় কোনো গহ্বরে আর চোখ খুলে রগড়াতে থাকে দেখার চেষ্টায়..’
‘গ্যাসপার নড়ে ওঠে, উঠে বসে আর আবার মাথা নাড়ায় এপাশ থেকে ওপাশে, আবার মৃত্তিকাময় পৃথিবীর অভিযোগকে অস্বীকার করতে, তবে সে এখনো বন্দী ঘুমে এবং মৃত্যুতে, বেঁধে রেখেছে সেই সাপ যার কুণ্ডলীতে রয়েছে ছয়শত প্যাঁচ যা তৈরি হয়েছে কাদামাটি, গাছপালা, বৃষ্টি, চাঁদ, গিরিশৃঙ্গ, পাহাড়, পাখি, হ্রদ আর বজ্রপাত দিয়ে, আর সেই সব প্যাঁচ তার হাড়গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে, আর তারা দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে তার শরীর টাকে এককৌটা ভেরেন্ডার বিচি বানিয়ে ফেলছে আর গভীর রাত নামছে, বৃষ্টির মতো নামছে।
এবং সে শুনছে, কানের মোটা ছিদ্র দিয়ে সে শুনছে- ‘হলুদ খরগোশেরা আকাশে, হলুদ খরগোশেরা বনে-বাদাড়ে, হলুদ খরগোশেরা নদীসমুদ্রে রক্ত তাকে টেনে তুলবে, তার নদী তাকে টেনে তুলবে, তার কথামালার সূক্ষ্ম রক্তপারের পাশে থেকে লড়বে। গ্যাসপার ইলোমের লড়াই শুরু হবে, তার গিরেগুলো তাকে টেনে তুলবে…’
জমিনের শব্দগুলো সূর্যের আগুনে জ্বলে উঠলো, সেগুলো পুড়ে দিতে লাগলো আসমানী খরগোশের লোমাবৃত কানগুলো, বনে বাদাড়ের খরগোশগুলো, নদীসমুদ্রের খরগোশগুলো; তবে গ্যাসপার হয়ে উঠছে জমিন যে জমিন পতিত হচ্ছে পতিত হওয়ার জায়গা থেকে, অর্থাৎ সে হয়ে উঠছে স্বপ্ন-ঘুম যে ইলোমের জমিনে স্বপ্ন দেখার কোনো ছায়া পায় না, এবং সূর্যের আগুনও হারিয়ে ফেলছে দহনতেজ, ফলে তার স্বরশক্তিকে হলুদ খরগোশেরাও করছে ঠাট্টা, ঠাট্টারত খরগোশেরা পেঁপে গাছে বসে খাচ্ছে মায়ের দুধ, খেতেখেতে তারা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে পেঁপেতে, তারপর নক্ষত্র হয়ে ঝুলছে আকাশে, তারপর কানওয়ালা ছায়া হয়ে বিস্তৃত হচ্ছে নিচের নদীসমুদ্রে।
উলঙ্গ জমিন, জেগে ওঠা জমিন, ঘুমজড়িত ভুট্টার জমিন। গ্যাসপার পতিত হচ্ছে যেখান থেকে পতিত হয় জমিন, ভুট্টার জমিন যা নদীর পানিতে নেয়ে উঠেছে যে পানি অনেকদিন ধরে জেগে থাকায় গন্ধ ছড়াচ্ছে, যে পানি ঘুমহীন সুবজ রঙের, যে ঘুমহীনতা এমন বনের যা উৎসর্গীত হয়েছে ভুট্টায় বানানো মানুষের জন্য, ভুট্টা জন্মানো মানুষের জন্য। শুরু থেকেই ভুট্টা-জন্মানো মানুষেরা তাদের শরীরে দহন নিয়ে এগিয়ে ছিল, এবং তাদের কুঠার নিয়ে এগিয়ে ছিল, এগিয়ে ছিল তাদের পিতাপিতামহের বৃক্ষাচ্ছাদিত জমিনের দিকে, সেখানে রয়েছে হাজার বছর বয়সী দুই শত হাজার সাইবা বৃক্ষ।
[জেরাল্ড মার্টিনের ইংরেজি অনুবাদ থেকে মৎকৃত বাংলা অনুবাদ]
কী বুঝলেন? কিছু না বুঝলেও এটুকু সহজেই বুঝেছেন যে, আস্তুরিয়াস আমাদের সামনে তুলে ধরছেন এমন এক দুনিয়া যে দুনিয়া আমাদেরটা থেকে আলাদা। ফলে সেই দুনিয়ার গল্পটি যে আমাদের দুনিয়ার গল্পটা থেকেও আলাদা হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। তবে সেই সহজ অনুমানটা আমরা সহজে করতে পারছি না। ফলে আমাদের গল্পটা সেখানে খুঁজতে গিয়ে আমরা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছি এবং গল্পটাকে আমাদের করে নিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা যে বাঁকে বসে তার উপন্যাসটি পড়তে চেষ্টা করছি, তার দুনিয়াকে বোঝানোর জন্য লেখককে সেই বাঁক পেরিয়ে নতুন বাঁকে পৌঁছে গিয়ে উপন্যাসটি লিখতে হয়েছে বলে আমরা সে উপন্যাসের সাথে তাল রেখে আগাতে পারছি না।
আমরা বুঝতে পারছি না উদ্ধৃতির মাঝের কথাগুলো কার। আমরা বুঝতে পারছি না ভাষা কেন বস্তুকে নির্দেশ না করে বস্তুরাজ্যের অন্তর্গত উপমাগুলোকে নির্দেশ করতে আকুলিবিকুলি করছে। আমরা বুঝতে পারছি না কারণ আমাদের অনুবাদ মূল লেখকের শব্দগুলোকে অনুবাদ করতে পারলেও এর মূল সিনট্যাক্সকে বা শব্দবিন্যাসকে তো অনুবাদ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, আস্তুরিয়াসের মূল স্প্যানিশে পড়েও একজন স্প্যানিশ জানা মানুষ এই ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে খুব বেশিদূর আগাতে পারবে না। কারণ, আস্তুরিয়াস এই উপন্যাস স্প্যানিশে লিখলেও, এর সিনট্যাক্স তিনি স্প্যানিশ থেকে নেননি, তিনি এর সিনট্যাক্স নিয়েছেন গুয়াতেমালার আদিবাসীদের কিশ (Quiche) ভাষা থেকে। এর বর্ণনা ধারা তিনি এনেছেন মায়া সভ্যতার পবিত্রগ্রন্থ ‘পোপোল বু’ থেকে। ফলে এর সিনট্যাকটিক বিন্যাসে রয়েছে দুটি ধারা। এক ধারায় রয়েছে শব্দের (morpheme) ক্রম যা কিশ ভাষার, আরেক ধারায় রয়েছে গল্প-একক বা মিথিমের (mytheme) ক্রম যা তিনি নিয়েছেন মায়া সভ্যতার পবিত্রতম গ্রন্থ পোপোল বু থেকে। আস্তুরিয়াস ৪০ বছর ধরে কাজ করেছেন এই পোপোল বু নিয়ে এবং অনেক ক্লেশে তিনি এই গ্রন্থকে স্প্যানিশে রূপান্তর করেছেন এর মূল ভাষার সিনট্যাক্সকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে।
ফলে আস্তুরিয়াস তার জগৎকে এবং সেই জগতের সমস্যাকে উপস্থাপনের লক্ষ্যে উপন্য্যাসকে যে বাঁকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন আমরা পাঠকরা সেই বাঁক পর্যন্ত এখনো পৌঁছতে পারিনি— এ কথা খুব লজ্জা-শরমে না পড়েই আমরা বলে দিতে পারি।
[ উত্তরপর্ব, শরৎ-হেমন্ত সংখ্যা ১৪৩১ থেকে সংকলিত]