ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের নারী যোদ্ধাটিকে কালো একটা হিজাব পরিয়ে দিয়েছিল কেউ। এই ‘কেউ’টা যে কে, সেটি সবার কাছে পরিস্কার।
গণতন্ত্রকে খু*ন করে ইসলামি ফ্যাসিবাদ ও মোল্লাতন্ত্র কায়েম করতে যারা আজ ক্ষমতায় জেঁকে বসেছে, তারা এখন নানা ধরনের খেলা খেলছে। যেহেতু বাংলাদেশে একটা প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি এখনও জীবিত আছে; যারা মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও কৃষ্টিতে বিশ্বাস ও আস্থা রাখে, তারাই মৌলবাদীদের এই সমস্ত খেলায় মূল বাধা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। যখনই এসিড টেস্টের মতো হিজাব পরানো, নারীর পোশাক নিয়ে কটুক্তি, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা বলা, কিংবা সাত মার্চ, ১৫ই আগষ্ট নিয়ে নয় ছয়ের ইচ্ছে জাগছে কর্তৃপক্ষের, তখনই এক বিরাট অংশ মানুষ কোনো দ্বিধা না করেই হুংকার দিয়ে উঠছে। তাদের যুদ্ধ আজো জারি আছে। যে যুদ্ধ তারা শুরু করেছিল জুলাই আগস্টে, হয়তো একান্ত আপন মানুষটিকেও যখন অচেনা লাগছিল, কর্মক্ষেত্রে, ঘরে বাইরে সর্বত্র নিজেকে একা আর অপাঙ্কতেয় মনে হচ্ছিল, অনিরাপদ বোধ হচ্ছিল; তবু তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। তারা প্রথম থেকেই ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেছে, কিন্তু আক্রমনের ভয়ে, অনিশ্চয়তায় পড়ে চুপ হয়েছিল। কিন্তু এটি সত্যিই ইতিবাচক যে, এই ভয় পাওয়া, চুপ হয়ে যাওয়া মানুষেরা আজকে আবার জেগে উঠেছে।
যদিও এই দেশে আরেকটি অংশ মানুষও আছে, যারা জুলাই আগস্টকালে সরকার পতনের ছদ্মবেশী আন্দোলনে শরিক হয়েছিল, মৌলবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, বিভ্রান্ত হয়েছিল, স্রোতে গা ভাসিয়েছিল, লাল রঙের ডিপি লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল।
সেই লাল রঙের ডিপিধারীদের মধ্যে যে বিপ্লবী জোশ জুলাই আগস্টকালে দেখেছিলাম আমরা, অধিকাংশের সেই জোশ ক্রমে ম্রিয়মাণ হয়েছে, গলার স্বর কমে গেছে। এদের অনেকেই যোগ দিয়েছে আফসোস আর অনুশোচনাকারীদের দলে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাদের হতাশা তারা আর চেপে রাখতে পারেনি। তারা যে প্রতারিত হয়েছে, সেই অনুভূতিতে আক্রান্ত হতে তাদের দেরি হয়নি। ফলে সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই তারা – ‘‘আয়াম ফিলিং চিটেড” লিখেছে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার ঘণ্টা পাঁচেকের ভেতরেই। বিজয় মিছিলের সাথে শহরের রাস্তায় আনন্দ ফূর্তি করতে গিয়ে তারা দেখেছে গণভবনের ভেতরে চলছে স্মরণকালের সবচেয়ে অশ্লীল লুটপাট। এমনকি সাবেক বয়োজৈষ্ঠ্য প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বাসও এই অশ্লীলতা থেকে রেহাই পায়নি। তারা দেখেছে বিজয়ের নামে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি। দাউ দাউ লেলিহান শিখায় পুড়েছে ইতিহাস।
ভেঙে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের হাজার হাজার ভাস্কর্য। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের উপর দাঁড়িয়ে তারা মূত্রবিসর্জনের মতো কুৎসিত আচরণ করেছে। আমাদের লাল বিপ্লবীরা দেখেছে, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার সাথে সাথে বিপুল আক্রোশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে জামাত শিবির ও বিএনপির লোকজন। এই আক্রমনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সেই লাল ডিপিধারীরাও, যারা মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও জামাত শিবির, হিজবুত তাহরীর আর বিএনপি’র সাথে হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করেছে।
এরপরের ইতিহাস তো সবার জানা। নৃশংসভাবে হাজার হাজার পুলিশ হত্যা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হ*ত্যা, হ*ত্যা করে গাছে ল্যাপপোস্টে ফ্লাইওভার থেকে ঝুলিয়ে রাখার বীভৎস সব দৃশ্য – সব তারা দেখেছে। এরপর শুরু হয়েছে শিক্ষকদের অপমান, হেনস্তা, নোংরামির আয়োজন। বলাবাহুল্য এরকম নোংরা সময় বাঙালি জাতি আগে দেখেনি, যেখানে স্বজাতির হাতে হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, অপমানের ঘটনা ঘটে গেছে একের পর এক, অথচ কর্তৃপক্ষ নীরব। ডাকাতি হয়েছে, ছিনতাই হয়েছে। অথোরিটি চুপচাপ বসে আছে। এ কেমন সময়! কেউ মেলাতে পারেনি।
এর আগে দেশে ৯০ এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে জনতা ফুঁসে উঠেছে। পতন হয়েছে এরশাদের। কিন্তু তারপর? তারপর জনতা কি লুট করেছে? শিক্ষকদের জুতা দিয়ে মেরেছে? মানুষকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখেছে? গর্ভবতী পুলিশ অফিসারকে পুড়িয়ে মেরেছে? তাহলে এ কেমন আন্দোলন? আওয়ামী লীগ সরকারকে সরিয়ে যারা ক্ষমতায় বসেছে, তারা আসলে কাদের নিরাপত্তা দিতে ক্ষমতায় বসেছে?
এসব প্রশ্ন লাল ডিপিধারী বিপ্লবীদের মনেও আসবার কথা। এসেছেও। যাদের বিন্দুমাত্র বিবেকবোধ আছে, বুদ্ধিমত্তা সামান্যও অবশিষ্ঠ আছে, তারা হোঁচট খেয়েছে। তারা বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে। আত্মগ্লানিতেও ভুগেছে কেউ কেউ। আর আরেকটি অংশ, তারা এখনও গায়ের জোরে আগের অবস্থানে অটুট। কারণ দেশের চেয়ে ব্যক্তিগত ইগোর দাবি বেশি। সেই ইগো রক্ষার দাবিতে তারা এখনও নিজেদের সঠিক প্রমাণ করে যেতে চাইছেন। আর কেউ কেউ রয়েছেন স্বার্থান্বেষী, তাদের এজেন্ডা এখনো পুরোটা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে তারা চোপার জোরে চালিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যাই লিখছেন, দু’মিনিট পরেই মুখের উপর সশব্দে একটি থা*প্পড় এসে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ১৫ই আগষ্টের শোক দিবস বাতিল হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দেবার অভিপ্রায় এখন সুস্পষ্ট ক্ষমতাসীনদের চেহারায়, কথায়, আচরণে।
ড. ইউনুসের রিসেট বাটন এখন ওদের সবার হাতে। জাতিসংঘের সম্মেলনে গিয়ে ক্লিনটন সেন্টারে দেওয়া ড. ইউনুসের ভাষণ ছিল লাল বিপ্লবীদের মুখের উপর সশব্দে আছড়ে পড়া আরেকটি চ*ড়। তারা ভেবেছিল ছাত্র জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাছাড়া করেছে। এখন তারা ইউনুসের মুখেই জানলো, পুরো ঘটনাটাই দীঘদিনের সুপরিকল্পিত। আর এর পেছনে আছে হিজবুত তাহরীরের নেতা মাহফুজ আলমসহ আরো অনেকেই। তারা অনুধাবণ করলো এই ঘটনা আফগানিস্তানের মতো, ইউক্রেন, সিরিয়া, ইরাকের মতোই মার্কিনীদের আরেকটি চাল, আরেকটি বিধ্বংসী খেলা। যে খেলায় তারা লাল বিপ্লবীরা কেবলমাত্র পুতুলের ভূমিকাই পালন করেছে। জেনে বা না জেনে। তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, এমনকি আমেরিকান গণমাধ্যম, যারা অনুসন্ধানী রিপোর্ট, ফিচার করছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপর, সেসব লেখা থেকে জানলো, কয়েক বছর ধরেই টাকা ঢালছে আইআরআই, সিআইএ। ফলে তাদের অনেক সহযোদ্ধাই আসলে পেইড যোদ্ধা। তারা নিজস্ব ব্যক্তিগত লাভের জন্যই দেশ বিক্রি করেছে। দেশকে ঠেলে দিয়েছে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অনিষ্টের ঘটনাটি তারা নিজ হাতে ঘটিয়ে দিয়েছে। তারা মনে মনে ঠিকই টের পাচ্ছে, তারা আসলে দেশের সর্বনাশ করেছে।
আজকে দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে। অসংখ্য কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে হাজারো গার্মেন্টস কারখানা। বন্ধ হয়েছে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য শিল্প কারখানা। কোটি কোটি শ্রমিক এখন বেকার। বহু প্রতিষ্ঠানে বেতন ভাতা বন্ধ। বাজারে আগুন জ্বলছে। থানাগুলোতে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই আগের মতো। সব চলছে ঝিমিয়ে। সচিবালয়ে প্রাণ নেই। সবার মনে আতংক, অনিশ্চয়তা। শিক্ষাঙ্গনে চলছে অরাজকতা। অটো পাশ দেবার পরেও ফেলের ঘটনা ঘটেছে। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আবারো অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। রাস্তাঘাটে নারীদের নানাভাবে অপমান, হেনস্তা করা হচ্ছে। জামাত শিবিরের দৌড়াত্ম্য বেড়েছে, চলছে রগকাটার উৎসব। হাত পা কেটে নেওয়ার ঘটনাও চলছে সমানতালে। দেশ মাত্র ক’দিন আগে বড় ধরনের বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল। সেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণও যায়নি ঠিকমতো। অথচ সাধারণ মানুষ সমন্বয়কদের বিশ্বাস করে দান করেছিল ত্রাণ তহবিলে। সেই টাকার নয় ছয়ের ঘটনাও সবার জানা। শুধু তাই নয়, সারা দেশে সমন্বয়কদের অগ্রহণযোগ্যতার খবর পেয়েছি আমরা। সবাই তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
আজ দেশ কিসের পিঠে চলেছে কে জানে! সেই উদ্ভট উটের পিঠেই, এ সত্য! দেশ দখলে নিয়েছে জঙ্গীরা। গত জুলাই আগস্টে এ দেশে প্রকৃত অর্থে একটি বিশাল আকারের জঙ্গী হামলা হয়েছে। আর এই জঙ্গী হামলায় মদদ দিয়েছে এই দেশেরই মাথামোটা, উঠতি বিপ্লবী জনগন। তারা একটি সরকার পরিবর্তন করতে চেয়েছে। কিন্তু আদতে হাত মিলিয়েছে চরমপন্থী জঙ্গীদের সাথে। এই ভুলের কোনো ক্ষমা হয়না। হবেও না। জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধে, দেশের গান গাইতে গাইতে তারা দেশটাকে তুলে দিয়েছে সেই পুরোনো শকুনের হাতে। এর দায় তারা এড়াবে কীভাবে?
#ATeam 20241060
See translation
All reactions:
270270