‘মরিলে হইবো মাটিতে বাসা, পড়িয়া থাকিবে লক্ষণশ্রী আর রঙের রামপাশা।’ অমর এই কালজয়ী গানের স্রষ্টা মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী।
এই গানের মতই সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার হাছন রাজার পৈত্রিক বাড়িটি এখন অবহেলা আর অযত্নে মাটির সঙ্গে মিতালী করে নিরবেই কাঁদে। হাছন রাজার রঙের রামপাশার স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ। কিন্তু এই বাড়িতেই হাছন রাজার কেটেছে জীবন-যৌবন।
জানা গেছে, হাছন রাজার বাবা দেওয়ান আলী রাজা ছিলেন একজন প্রতাপশালী জমিদার। তার আওতায় দুই স্টেটের জমিদারি ছিল। যার একটি বিশ্বনাথের রামপাশা ও আরেকটি সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী। রামপাশার জমিদারি দেখাশুনা করতেন তার বড়ভাই উবাইদুর রাজা চৌধুরী। হাছন রাজার যৌবনের প্রারম্ভেই তার বাবা ও একমাত্র বড় ভাইকে হারান। এজন্য মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাছন রাজার কাছে চলে আসে দুই স্টেটের জমিদারি। তবে জমিদারির মূল দেখাশুনা করতেন তার মা হুরমত জাহান। ৫ লাখ ২০ হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন হাছন রাজা। এখনও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জ, লক্ষণশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব রয়েছে। হাছন রাজার বিশাল জমিদারি থাকা সত্ত্বেও গড়ে তুলেননি কোনো রাজপ্রাসাদ। যেটুকু আছে তাও ধ্বংসের পথে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাছন রাজার রামপাশার বাড়িটিতে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতি নেই। যা আছে তাতেও বাসা বেঁধেছে পোকামাকড় আর পরগাছা। আছে দুতলা একটি ঘর ও ছাদবিহীন একটি ঘরের চার-দেয়াল। ঘরটিতে পশুপাখির মূলমূত্রও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেন খুঁয়ে খুঁয়ে পড়ছে ঘরগুলোর ইট ও প্লাস্টার। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে থেকে যেন তার সৃষ্টি গানের মতোই বিলাপ করছে হাছনের পৈত্রিকভিটা।
আরও দেখা গেছে, অন্দরমহলের জন্য বাড়ির উঠানে তৈরি সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো প্রাচীন ইটের দেয়াল রয়েছে। যা লতাপাতায় ঘেরা। বাড়ির রাস্তার পাশে ইংরেজিতে লেখা একটি ফলক রয়েছে। বাড়ির পূর্বপাশে মাদ্রাসা, মসজিদের সামনে কবরস্থানে রয়েছে বাবু রায় চৌধুরী ওরফে বাবু খান সমাধি। রয়েছে তার তৃতীয় স্ত্রীসহ বংশধরদের কবর। বাড়ির সামনে পেছনে কয়েকটি পুকুর ও একটি বিশাল দিঘি রয়েছে। এই কয়েকবছর আগে পুকুরে শান বাঁধানো ঘাট ও ঘাটে শতবছরের পুরানো পাথর দেখা গেলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না।
স্থানীয়রা জানান, উদ্যোগ নিয়ে বাড়িটি কিছুটা সংস্কার আর সংরক্ষণ করলেই বাড়িটি হয়ে উঠতো বিশ্বনাথ উপজেলার একমাত্র পর্যটন স্পট। অনেক আগে থেকেই এ দাবি করে আসছিলেন হাছন ভক্তরা। কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নের আলো দেখেনি। এখন সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে হাছন রাজার এ স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখবেন এটাই প্রত্যাশা করেন হাজারো হাছন ভক্তরা।
স্থানীয় হাছন ভক্ত বাউল শাহ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হাছন রাজা হাজারো গান রচনা করেছেন। তার গানগুলোসহ স্মৃতিচিহ্ন বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
বাড়ির দায়িত্বে থাকা পংকি মিয়া বলেন, কয়েকবার পরিবার থেকে বাড়িটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে আর হয়ে উঠেনি। তার বংশধররা প্রতি ঈদে বাড়িতে আসেন। এলাকার অসহায়দের মাঝে বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করেন।
প্রবীণ সাংবাদিক ও গবেষক সাম্যবাদী কবি সাইদুর রহমান সাঈদ কালবেলাকে বলেন, হাছন রাজা মরমী সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য ইতিহাস। তার স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। পরিবার থেকে না হলেও সরকারি উদ্যোগে এই বাড়িটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজ সুনন্দা রায় কালবেলাকে বলেন, জেলা প্রশাসক অফিস থেকে উপজেলায় দর্শনীয় স্থানের ব্যাপারে বিস্তারিত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল। আমরা বিশ্বনাথ উপজেলার একমাত্র সম্ভবনায়ময় পর্যটন স্পট হিসেবে হাসন রাজার বাড়ির নাম পাঠিয়েছি। পাশাপাশি হাসনরাজার বাড়ির দিঘি, পুকুরসহ বাড়িকে ঘিরে প্রকল্প আকারে পাঠানো হয়েছে। এতে করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজস্ব আয় হওয়ার সম্ভবনাও উল্লেখ রয়েছে। আশা করি সরকারিভাবে বাড়িটি সংরক্ষণ করে পর্যটন স্পটে রুপান্তরিত করা হবে।