দেশে বেকারত্বের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজারে পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
রবিবার (৫ জানুয়ারি) ওই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিবিএস প্রথমবারের মতো শ্রমশক্তি জরিপে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ১৯তম আইসিএলএস পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এই পদ্ধতিতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেলেও ১৩তম আইসিএলএস অনুযায়ী বেকারত্বের হার তুলনামূলক কম, যা তৃতীয় প্রান্তিকে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশে নেমেছে। কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজারে। এটি এক বছরের ব্যবধানে ৩৫ লাখ কম।
বিনিয়োগ সংকট
অর্থনীতিবিদদের মতে, গত এক বছরে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বিনিয়োগের হার কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ পরিস্থিতি শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, ব্যাংকের উচ্চ সুদহার এবং ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে কর্মসংস্থানের সংকট আরও বাড়ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
তিন খাতে নেতিবাচক প্রভাব
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, তিনটি প্রধান খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। এক বছরের ব্যবধানে কৃষি খাতে ১৫ লাখ ৭০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বর্তমানে এ খাতে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার। শিল্পখাতেও কাজ হারানোর হার উল্লেখযোগ্য। এক বছরে শিল্পখাতে ৭ লাখ ৬০ হাজার কর্মী কাজ হারিয়ে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজারে। এক বছর আগের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ।
শিল্পখাত নিয়ে মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুত সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে শিল্পকারখানাগুলো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগে অনাগ্রহ বাড়ছে, যা শ্রমবাজারে দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করতে পারে।’
ডলার সংকট
ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক মুদ্রার মূল্য ওঠানামাও শ্রমবাজারের সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। গত দুই বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা বর্তমানে সরকারি হিসাবে ১২২ টাকা। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে মুনাফা প্রত্যাহার করতে পারছেন না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ডলারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি।
এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফআইডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘দেশে যত বেশি উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানও তত বৃদ্ধি পাবে। গত এক বছরে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বিনিয়োগ বাড়ালেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আর বেকারত্বের হার কমবে। তবে বর্তমানে বিনিয়োগের পরিবেশ অনুকূল না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সময়ে দেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশেরও নিচে। বিনিয়োগ ও উৎপাদন না বাড়লে এই প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে। এতে কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতেও কর্মসংস্থানের সংকট বাড়বে।’
বেকারত্বের দীর্ঘমেয়াদি সংকট
দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান পান, বাকিরা বিদেশে যান। কিন্তু গত দুই দশকে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবিলম্বে কার্যকর নীতি গ্রহণ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না করলে বেকারত্বের হার আরও বাড়বে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
এ ইউ/