HomeUncategorized৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ;ঝুকি বাড়বে অর্থনীতিতে

৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ;ঝুকি বাড়বে অর্থনীতিতে

অন্তর্বর্তী সরকার ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে । সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপেই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনতে যাচ্ছে সরকার। এতে তৈরি পোশাক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, কয়েল ও টিস্যু পেপার, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। ভ্যাট বাড়লে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে বাজেটের আগেই এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো।

মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধিত খসড়া অধ্যাদেশের অনুমোদনের বিষয়টি বৈঠক শেষে জানানো হলেও ভ্যাটের বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।

অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না। কারণ, অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল ওয়েটের ইন্ডিকেটরগুলো হলো চাল, ডাল এগুলো। আর আমরা যেসব জিনিসের ওপর কর বাড়াচ্ছি, এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।’

সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না কষ্ট হবে।’ 

অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভ্যাট হার বাড়ানো হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজস্ব আয় বাড়ার পরিবর্তে উলটো কমতে পারে। তারা বলছেন, এমনিতেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সেখানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ বা সস, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান-ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পলের ওপর ভ্যাট হার বৃদ্ধি মানুষকে আরও চাপে ফেলবে। 

বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এখনও লোকসান কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। 

জানা গেছে, সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। তখন চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয়েছে আইএমএফ। এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে। এমনকি অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। 

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, এই অবস্থায় ভ্যাট হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে নিশ্চিতভাবেই। তিনি মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুচারু গবেষণা ও সুচিন্তিত বিশ্লেষণ ছাড়া ভ্যাট হার বাড়ানো হলে তা অর্থনীতিতে সুফল না-ও আসতে পারে। এমনকি এই সিদ্ধান্তের ফলে অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। 

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, যেসব পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর কথা হচ্ছে, সেখানে সিগারেট বাদে প্রত্যেকটি পণ্য জীবনমানের সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয়। সেক্ষেত্রে এগুলোর দাম বেড়ে গেলে মানুষের জীবনমানের ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। 

প্রসঙ্গত, সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় মাধ্যম হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে এখনও লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতার আনা সম্ভব হয়নি। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে পারেনি এনবিআর।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এখনও রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই রাজস্ব ঘাটতি মেটাতেই নতুন করে ভ্যাট আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। 

প্রস্তাবিত ভ্যাট বাস্তবায়ন হলে রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর সাধারণ মানুষকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এত দিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বা এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে রেস্তোরাঁ মালিকরা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ভ্যাট বাড়ানো হলে ব্যবসায় ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ভ্যাটের সঙ্গে আয়করও বেড়ে যাবে। এতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

তিনি অভিযোগ করেন, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁকে ধ্বংস করে দিয়ে এই শিল্প করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার অপতৎপরতার অংশ এটি।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ ব্যবসায় উৎপাদন ও পরিচালনার ব্যয় বাড়াবে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যে প্রতিফলিত হয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করবে। তিনি মনে করেন, ‘এই সিদ্ধান্তের ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ছে 

এতদিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হচ্ছিল। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। পাশাপাশি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাটের হার বাড়তে পারে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মিষ্টি কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভ্রমণের ক্ষেত্রে নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট হারও বাড়তে পারে। বর্তমানে নন-এসি হোটেল সেবার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

এ ছাড়া অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি।

এ ছাড়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মদের বিলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে।

আমদানি, উৎপাদন ও সেবা পর্যায়ে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। যেমন আমদানি পর্যায়ে ফলের রসে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, তামাকে ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ, সুপারিতে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কথা বলায় (টকটাইম) সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। ভ্রমণে আবগারি শুল্ক বাড়তে পারে। ফলে আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বেড়ে যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হতে পারে। আর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হতে পারে।

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত