মহাকাব্যিক বিস্তৃতির এক ঊষর-ধূসর প্রান্ত ছুঁয়ে ক্রমশ সম্মুখে ধাবিত হয়েছে নাট্যদৃশ্য। নাটকে ধাবমান দৃশ্যসকল নির্মাণ করে জীবনের প্রতি অমোঘ আকর্ষণের দ্যোতনা। এ অঞ্চলের মানুষের সহজাত স্বাভাবিক জীবন গাঁথার মাঝে আশ্রয় পেয়েছে প্রকৃতি ও সৃষ্টির প্রতি প্রেমের অভূতপূর্ব নিদর্শন। গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী সোমেশ্বরীর নির্জন তীরে বনের গায়ে রোদের প্রতিবিম্বের নাচনের মতো বীর সোহরাব ও বিশালবপু অজগরের লড়াই দিয়ে হয় নাট্যদৃশ্যের গোড়াপত্তন। যে ভয়ংকর লড়াই প্রবণতা বীর সোহরাব পেয়েছিল তা কি শিশুকালের এই ঘটনার দরুন নাকি এই ষণ্ডের পূর্বপুরুষেরা চন্দ্রদেবী ছুছুমির মাতৃশ্রাদ্ধে বলির নিমিত্তে ধৃত হওয়ার কারণে উত্তরপুরুষে সেই তেজ রয়ে গিয়েছিল, তা দর্শকের মননে প্রশ্নের উদ্রেক করে যায় সহসা। কে এই বীর সোহরাব?
যে দৃশজাত সোহরাবকে নাট্যোমোদী দর্শক খুঁজে চলেছেন তার রহস্য ভেদ করতে হলে আমাদের যেতে হবে আরও গভীরে। দৃশ্য ও ঘটনার ধাবমানতা দিয়ে যে নাট্য আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন সেলিম আল দীন, শুধু লেখার খাতায় অক্ষরের কিছু জীর্ণ কঙ্কাল দিয়ে বোঝা যাবে না তাকে।
গত ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৩য় বর্ষের (৪৯ তম আবর্তন) চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। নির্দেশনা দিয়েছেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনন জামান। সেলিম আল দীন রচিত ধাবমান দৃশ্যের নাটকটি কিছু কঠোর পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল অভিনেতা, গায়ক ও বাদকের চরিত্রজাত হয়ে জীবন্তরূপ পরিগ্রহ করেছিল সেদিন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের থিয়েটার ল্যাব- ৩ কক্ষে। দর্শকের মনন ও চিন্তায়, আবেগ ও উদ্দীপনার দ্যুতিকল্প নির্মাণে একটি সফল মঞ্চ প্রযোজনা হিসেবে উপবিষ্ট হয় নাটকটি। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তার পালিত কন্যা অন্বিতার সুস্থতা ও মঙ্গল কামনায় যে প্রার্থনার বীজ বপন করেছিলেন এই নাটক রচনার উর্বর ভূমিতে, তা যেন ধাবমান ষণ্ডের দ্রুতগামী পায়ের আঁচড়ে আঁচড়ে লেপ্টে গেছে এই ক্ষয়িষ্ণু বঙ্গ জনপদের অধিবাসীদের মননচিত্তে।
গারো পাহাড়ের প্রাচীন কোনো ঢল বেয়ে নেমে আসা উজানী খরস্রোত থেকে জন্ম নেওয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভগ্নাবশেষ থেকে অমৃত সুধা পান করে তীব্র জীবনীশক্তি নিয়ে মা হামেলার গর্ভে জন্মলাভ করেছিল শিশুষন্ড সোহরাব। নহবত আলীর দ্বিতীয় বিয়ের কালে নববধূ সুবতীর সাথে এই ঘরে এসেছিল নীলাম্বরি নামের বকনাবাছুর। তারই কন্যা হামেলা। সোহরাবের জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ধাপে নহবত আলী তার পুত্র এসহাকের সমান্তরালে ভালোবেসেছিল ষণ্ড সোহরাবকে। আর তাতে করে ষণ্ড সোহরাবকে শিশুপুত্র এসহাকের হিংসার শিকারও হতে হয় একসময়। তবু বীর সোহরাব নহবত আলীর কাছে যেমন পিতৃস্নেহ পায়, সুবতীর কাছে পায় মাতৃস্নেহ, এসহাকের কাছে পায় ভ্রাতৃস্নেহ। পরিবারের অপত্য স্নেহ যেন সোহরাবকে আরও বেশি প্রলয়ংকরী করে তোলে। রচনা করে কৃত্যের ইতিহাসে মানতের এক ষণ্ড বয়ারের কাছে কসাইয়ের শোচনীয় হারের এক মহিষগাথা।
শৈশব থেকে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে বেড়ে ওঠা সোহরাব হারিয়ে দেয় প্রবল পরাক্রমশালী বয়ার রাজপংখিকেও। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিণতি যেন স্রষ্টা লিখেছেন কোনো সুদূর অতীতকালে যে বয়ারের গলায় কসাইয়ের ছুরির আঁচড় পড়বেই। সেই অখণ্ডনীয় নিয়তির পরেও দেখা যায় চন্দ্রদেবী ছুছুমির মাতৃশ্রাদ্ধে বলির নিমিত্তে ধৃত হয়েছিল যার পূর্বপুরুষ, তাকে কি সহজে কোনো অনাম্মী কসাই পর্যুদস্ত করতে পারে? বীর সোহরাব পালিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে চলে যায় মান্দি পাড়ায়। সোহরাবের পেছনে ধাবমান দস্যুদের অনেকেই তার খুরের আঘাতে পর্যুদস্ত হয়। নির্বিঘ্ন চিত্তে মান্দি পাড়ায় পৌঁছালে, মান্দি আৎছু তাকে আশ্রয় দেয় মুনীন্দ্র মারাকের জীর্ণ কুঠিরে। এই মুনীন্দ্র মারাকই একশ দুই কি চার বছর বয়সে স্বর্গ গমনের আগে বীর সোহরাবকে দিয়েছিল আর্শি বচন। তবু সোহরাবের সন্ধান থামে না, একদল দস্যু মান্দি পাড়ায় এসে পৌঁছালে মান্দিরা সোহরাবকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। মুখোমুখি লড়াইয়ের পরে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয় নিজ নিজ গ্রামে। কিন্তু দস্যুদের থেকে পালিয়ে বাঁচলেও বীর সোহরাবের মন টেকে না বাড়ি ছাড়া, নিজ গোয়ালঘর ছাড়া। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সোহরাব ফিরে আসে নিজ ঘরে। আর তখনই তাকে পাকড়াও করে ওত পেতে থাকা কসাইয়ের দল। এ যেন বীর সোহরাবের সহজ আত্মসমর্পণ। যদিও নাট্যকার এখানেই নাট্যঘটনার ইতি টানেননি। তবে নির্দেশক বীর সোহরাবের আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই শেষ করেছেন এই নাট্যদৃশ্যের ধাবমানতা। শেষ দৃশ্যে রেখে গেছেন সৃষ্টির প্রতি মানুষের এক আপ্লুত ভালোবাসার প্রকাশ।
নাটকটি সম্পর্কে নির্দেশক আনন জামান বলেন– “ধাবমান প্রাত্যহিক সরল যাপনের গভীর ভাবপ্রকাশক দর্শনসমৃদ্ধ নাট্যভাষ্য। সমগ্র গল্পে নাট্যস্থিত সম্প্রদায়ের কসমোলজি কী সাংস্কৃতিক মিশ্রণ কী সম্প্রদায়গত নৃতাত্ত্বিক বৈরিতার মধ্যে শুভ স্বস্তির অন্বেষণ বিদ্যমান। গল্প বয়ানের শিল্প কৌশল প্রসঙ্গে সেলিম আল দীন বলেছেন, ‘এক চারণিক মান্দি কবি সোহরাব বধের প্রত্যক্ষদর্শী অথবা এ অন্য কোনো ধরনের কোনো কবির কল্পনাজাত গল্প মাত্র।’ পরীক্ষা প্রযোজনায় সোহরাবকে আখ্যানের কেন্দ্রে রেখে একটি সহজিয়া গল্প বলার প্রচেষ্টা ছিল। প্রযোজনাটিতে বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির প্রয়োগ মুখ্য প্রবণতা হলেও চরিত্রাভিনয় রীতি অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। আখ্যান বহনকারী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের পোশাকের ক্ষেত্রে চরিত্রানুগ পোশাক ব্যবহারের চেষ্টা ছিল। সেট ও প্রপসে নাট্যস্থিত জনপদের নিসর্গ রঙের বিভিন্ন ধরণ প্রয়োগের প্রচেষ্টা ছিল। ধাবমান একটি বিস্তৃত ক্যানভাসের মহাকাব্যিক আখ্যান। নগদি মান্দিদের সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সামগ্রিক ব্যাপকতার নিখুঁত শিল্পভাষ্য নাটকটিতে বিদ্যমান। নির্ধারিত সময়ে প্রযোজনাটি সম্পন্ন করতে শিক্ষার্থীদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আশাকরি ক্রম প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে প্রযোজনাটি যথোচিত শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠবে।”
প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই নাটকটি দর্শকের মননে উদ্দেলতা তৈরি করতে সক্ষম হয়। মঞ্চে অভিনেতা ও কলাকুশলীদের উদ্যমী কর্মযজ্ঞ দর্শক ভাবুক করে তুলেছে মুহুর্মুহু। ‘সেট ও প্রপস’ ব্যবহারে নির্দেশক ছিলেন মিতব্যয়ী। তিনদিক খোলা গোলাকৃতির প্রায় নিরাভরণ মঞ্চের উপরে ঝুলতে দেখা যায় সলতে-হারিকেন। সংগীত দল বসেছে একপাশে, অন্য তিন পাশে দর্শক। এ যেন দর্শককে গ্রাম্য বাড়ির উঠানে প্রাচীনকালের অশ্বীতিপর গল্প বলার ধরনকে মনে করিয়ে দেয়। নাট্যাচার্য নিজেও ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যধারাকে প্রণম্য বিবেচনা করেছেন সর্বদা। নাটকটির নিরাভরণ বা ন্যূনতম আভরণ দর্শকের মনে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যধারার আধুনিক মঞ্চায়নকেই যেন স্পষ্ট করেছে। সংগীতের ব্যবহারে সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া গেলেও বিজ্ঞ দর্শকের কাছে পূর্ণরূপ চাহিদা পূরণে কিছুটা হলেও নিরাশ করেছে। হয়ত চমৎকার একটি সংগীত ও দোহার হলের প্রতি প্রত্যাশা অধিক থাকাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে।
নাটকটিতে গারো জনপদের সম্মুখ অবস্থান থাকায় তাদের সুরে ও ঢঙে সংগীত প্রয়োগের বিষয়টি লক্ষণীয়। মান্দি ঐতিহ্যবাহী সুরে গান পরিবেশনের সাথে নৃত্যও সংযুক্ত করা হয়েছে তাদের (মান্দি/গারো) মতো করে। এ যেন নাটকটিতে ভিন্ন দ্যোতনা যুক্ত করেছে। ‘ধাবমান’ নাটকটিতে সুর ও সংগীত পরিকল্পনায় ছিলেন সায়ীম ওয়াসিব ও নবীন কিশোর গোস্বামী। নবীন কিশোর গোস্বামী বলেন– “সেলিম আল দীন রচিত ‘ধাবমান’ নাটকটি পড়তে গিয়েই কানে আবহমান বাংলার মাটির সুর বাজতে থাকে। তাই নাটকের সংগীত এবং আবহ সংগীত নিয়ে প্রাথমিক ভাবনায় স্থির করি এই নাটকে দোতারা, ঢাক এবং বাঁশি হবে মূল তিনটা বাদ্যযন্ত্র। বাকি আরো যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে আবহ তৈরি করছি সেগুলোও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু নাট্যঘটনার প্রয়োজনে একমাত্র পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র কিবোর্ড ব্যবহার করেছি। প্রাকৃতিক শব্দ তৈরির ক্ষেত্রে অ্যালুমিনিয়াম শিট সহ বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছি। নাটকের গানগুলো টিমেরই আরেক সদস্য সায়ীম ওয়াসিব এবং আমার (নবীন কিশোর গোস্বামী) লেখা। নাটকের গান লিখতে গিয়ে এবং সুর করতে গিয়ে মাথায় রাখতে হয়েছে নাটকের প্রেক্ষাপট, যেহেতু নাটকে একই সাথে মান্দি বা গারো সংস্কৃতির উপাদান বিদ্যমান রয়েছে এবং বিদ্যমান রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদান। নাটকের একটি বিশেষ অংশে সোহরাবকে ‘রে রে’ গান শোনাতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ আছে। প্রথমে এই অংশে মান্দি ঐতিহ্যবাহী ‘রে রে’ গান ব্যবহার করব বলেই স্থির করি কিন্তু ভাষাগত জটিলতার কারণে পরবর্তীতে মান্দি ঐতিহ্যবাহী সুরের ওপর ভিত্তি করেই ‘পদ’ রচনা করি যার মূল বিষয়বস্তু নারী পুরুষের অকৃত্রিম প্রেম। সামগ্রিক ভাবে ‘ধাবমান’ নাটকের সংগীত পরিকল্পনার বিষয়টি আমার ঝুলিতে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।”
সংগীত প্রয়োগ ও দোহার দলে আরও ছিলেন– কিরণ সূত্রধর, আলিম উদ্দিন আকাশ, তন্ময় চন্দ্র রায়, ঐশী মোদক অরিন ও ইফাত আরা।
নাটকটির কোরিওগ্রাফিতেও সহজ-সাবলীল ভাবনার প্রকাশ দেখ যায়। সেইসাথে গারো নৃত্যের সৃজনশীল প্রয়োগও চোখে পড়ে সকলের। সাইমুম ইসলাম ও ঐশী মোদক অরিন নাটকটিতে কোরিওগ্রাফের দায়িত্বে ছিলেন।
নাটকটির সামগ্রিক ভাবনায় যেহেতু নিরাভরণ বা স্বল্প আভরণ আঙ্গিকের প্রকাশ ছিল, বিধায় পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও সেই ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। ‘বয়ার’ চরিত্রগুলোকে কালো রঙের পোশাকে আবৃত করে সহজেই দর্শকের দৃষ্টিতে তাদেরকে আলাদা করা গেছে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রের পোশাকের ক্ষেত্রে একটি কমন পোশাক রেখে চরিত্রানুযায়ী উপর্যুক্ত পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে। নাটকটিতে পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন: আনন জামান ও সোলনারা তানিয়া। এছাড়াও পোশাক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন: সিনথিয়া হাকিম দ্বীপা, তানজিম উদ্দিন, সাদিয়া তাবাসসুম বৃষ্টি, সপ্তর্ষি বিশ্বাস ও নোশিন তাসনিম একরাম।
‘ধাবমান’ নাটকটি মঞ্চায়নের পর দর্শক অভিমুখে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে অভিনয় বা সামষ্টিক পরিবেশনার সৌন্দর্য। পুরোটি পরিবেশনাটি যেন এক সুতোয় গাঁথা একটি প্রযোজনা। সেলিম আল দীনের মহাকাব্যিক বিস্তৃতি সমৃদ্ধ নাটকের ক্ষেত্রে নির্দেশকের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হচ্ছে এমন ‘টিম বিল্ডআপ’ করা। সেটি সম্ভব হয়েছে অভিনেতা ও কলাকুশলীদের ঐকান্তিক চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফলে। নাটকটিতে ‘মুনীন্দ্র মারাক’ নামে একটি মান্দি প্রবীণের চরিত্র রয়েছে। নাটকে উল্লিখিত একশ দুই কি চার বছর বয়সী এই চরিত্রটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন অভিনেতা ঐন্দ্রিলা মজুমদার অর্ণা। নাটকটিতে অভিনয়ের পর বিপুল উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন– মুনীন্দ্র মারাক চরিত্রটি নাটকে দেবপোম হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। গারো নৃগোষ্ঠীর এই ১১০ বছর বয়সী মুনীন্দ্র মারাক গারো ও বাঙালি মুসলমান সবার কাছেই সমান শ্রদ্ধার। অসাধারণ সব গুণাবলি ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। গভীর দর্শন ও জীবনবোধে উজ্জ্বল এক প্রদীপ তিনি যেন সকলকেই আলোকিত করেন।” এছাড়াও নহবত চরিত্রে রবিন মিয়া, সুবতী চরিত্রে আঞ্জুমান আশা মীম, এসহাক চরিত্রে শরিফ মিয়া সহ অনেকেই স্বচ্ছন্দ অভিনয় করে দর্শকের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
নাটকটি মঞ্চায়নের পর দর্শক মহল থেকেও নানান ধরনের প্রশংসা মিশ্রিত সমালোচনার কথা শোনা যায়। বিজ্ঞ দর্শক পুনর্বার নাটকটি মঞ্চায়নের অনুরোধও জানিয়েছেন। এমনই একজন দর্শক নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং স্কুল অফ জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ সহকারী অর্থী দাস নাটকটি দেখে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন– “ধাবমান নাটকটি পাহাড়ি জলরাশির গতি নিয়ে কেবল সামনে এগিয়ে যায়। জীবন-মৃত্যু-জীবনের ধারা বুঝিয়ে যায় প্রাণ, প্রকৃতি, লোভ, বিশ্বাস, স্বার্থপরতা, আত্মোৎসর্গের এক অনন্য আখ্যান। নির্দেশকের নিজস্ব ভাবনা এবং প্রায় নিরাভরণ মঞ্চ পরিকল্পনায় নতুন ভাবে দেখা গেল নাটকটি। দর্শক হিসেবে নাট্যকারের যবনিকা দেখার লোভটি থেকেই যায়। নাটকটিতে পরীক্ষার্থী শিল্পীদের প্রচেষ্টা এবং প্রাণশক্তিকে বাহবা দিতেই হয়। একই সাথে বাহবা পান দর্শকেরা। বহুদিন পর এমন দর্শকের দেখা পেলাম, যারা যে কোনো প্রযোজনাকে শতগুণে গতিময় করে তুলতে পারেন। ক্রম মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাটকটি মেদহীন ও প্রাণবন্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
নাটকটিতে নিরাভরণ বা প্রায় আভরণহীন মঞ্চ পরিকল্পনা ভাবনার জন্য নির্দেশক আনন জামান ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। নাটকটির সেট ভাবনাও তার। সেট ও প্রপস নির্মাণে আরও ছিলেন: নোশিন তাসনিম একরাম, কিরণ সূত্রধর, ইশতিয়াক আহমেদ সজীব, মোঃ রবিন মিয়া, মুন্তাসির বিল্লাহ খান অর্পন, তানভির পালোয়ান অপূর্ব, শরিফ মিয়া, তন্ময় চন্দ্র রায়, নবীন কিশোর গোস্বামী, ঐশী মোদক অরিন, অনামিকা আহমেদ, চৈতি ও সংগ্রামী প্রীতি বাঁধন।
আলোক পরিকল্পক হিসেবে নাটকটিতে কাজ করেছেন পলক ইসলাম ও রাসেল ইসলাম।
নাট্যকারের বিস্তৃত নাট্য ভাবনাকে ছুরি-কাচি চালিয়ে মঞ্চায়নের জন্য নির্দিষ্ট পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন নির্দেশক নিজেই। স্বল্পায়তনের মঞ্চনাটক নির্মাণে এই ভাবনাটি প্রশংসনীয়। তবে যারা নাটকটি পূর্বে পাঠ করেছেন তারা এ ব্যাপারে আরও ভাবনার ফুরসত ছিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এই প্রযোজনাটির সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রযোজনা ব্যবস্থাপক মুন্তাসির বিল্লাহ অর্পন বলেছেন– “আমার ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা খুব কম সময়ে এই প্রযোজনাটি মঞ্চে আনতে পেরেছি। সেক্ষেত্রে আমি আমার সহপাঠী, সহঅভিনেতা ও কলাকুশলীদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কাজটি স্বার্থকভাবে সম্পন্ন করা গেছে। এছাড়াও নির্দেশকের যথাযথ দিক নির্দেশনা আমাদেরকে সহায়তা করেছে সঠিকভাবে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করতে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পাদন করায় হয়ত কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দর্শকের গোচরীভূত হতে পারে। আমরা পরবর্তী পরিবেশনায় সর্বাত্মক চেষ্টা করবো ভুলগুলি কাটিয়ে ওঠার।”
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন রচিত ও আনন জামান নির্দেশিত ‘ধাবমান’ নাটকটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন: মো: রবিন মিয়া (নহবত), আঞ্জুমান আশা মীম (সুবতী), শরিফ মিয়া (এসাক), ঐন্দিলা মজুমদার অর্ণা (মুনীদ্র মারাক), নারিন আফরোজ লিনসা (হারাধন, পড়শি), তন্ময় চন্দ্র রায় (পাগল), অনামিকা আহম্মদ চৈতী (নীলকম্বরী), সিনথিয়া হাকিম দ্বীপা (গ্রামবাসী), সংগ্রামী প্রীতি বাঁধন (গ্রামবাসী), নোশিন তাসনিম একরাম (গ্রামবাসী), ঐশী মোদক অরিন (গ্রামবাসী), সাদিয়া তাবাসসুম (হামেলা), ইফাত আরা (গ্রামবাসী), জান্নাতুল নাইমা (গ্রামবাসী), আলিম উদ্দিন খান (আনাজ খাঁ), ইশতিয়াক আহমেদ (সুজাত কসাই), মহিবুল্লাহ শেখ (কসাই), ওয়াসিবুল ইসলাম (সোহরাব), মোঃ মুন্তাসির বিল্লাহ খান অর্পন (আৎছু), কিরণ সূত্রধর (রতন মাস্টার), নবীন কিশোর গোস্বামী (কুজাত কসাই), মিনহাজুল ইসলাম পলক (পীর), মোঃ তানজিম উদ্দিন (ইমাম, বিচারক), সপ্তর্ষী বিশ্বাস (ময়াল, পাদ্রি), মেহেদী হাসান (শচীন্দ্র কুমার ঘোষ), তানভীর পালোয়ান অপূর্ব (বাজপঙ্খী, ইমাম), রিজওয়ান রাশেদ সোয়ান (পড়শি, বিচারক) ও সাকিব আহমেদ (গ্রামবাসী, বিচারক)।