পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের (ডিএমআরসি) ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী অভিজিত হাওলাদার ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তার সহপাঠীরা। সহপাঠীদের দাবি, চিকিৎসকদের গাফিলতি এবং ভুল চিকিৎসার ফলে অভিজিতের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পর ১০ হাজার টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই ঘটনার সূত্র ধরে আজ রবিবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে হাসপাতালে ভাঙচুর করেছে ডিএমআরসির শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ঢাকার আরও ৩৪টি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কলেজ হলো, ঢাকা আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, দনিয়া কলেজ, আদমজী, গিয়াসউদ্দিন কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, ইমপিরিয়াল কলেজ, বোরহানউদ্দিন কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, লালবাগ সরকারি কলেজ, উদয়ন কলেজ, নটরডেম, রাজারবাগ কলেজ, নূর মোহাম্মদ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, গ্রিন লাইন পলিটেকনিক, ঢাকা পলিটেকনিক এবং মাহবুবুর রহমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রভৃতি। এসব কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাই মূলত এতে অংশ নেন।
ন্যাশনাল হাসপাতাল ভাঙ্চুরের পর ডিএমআরসি এবং বাকি ৩৪টি কলেজের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালান। সেসময় দুই কলেজেই স্নাতক প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান ছিল। এসময় দুই কলেজের শতাধিক পরীক্ষার্থী ইট-পাটকেলের আঘাতে আহত হন।
এসময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। সোহরাওয়ার্দী কলেজের মূল ফটকসহ ক্যাম্পাসে থাকা কলেজের মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কারসহ দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এছাড়াও ক্যাম্পাসের ডিজিটাল নোটিশ বোর্ডটিও ভাঙচুর করেন শিক্ষার্থীরা। কলেজের নিচতলা থেকে পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠে বাংলা, ইংরেজি বিভাগ ও অফিসরুমে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট করে তারা।
একই ভবনে অবস্থিত ইসলামিক স্টাডিজ এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগেও ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। বাদ যায়নি পরীক্ষার হলে থাকা বেঞ্চ ও উপাধ্যক্ষের কার্যালয়ও। তৃতীয় তলায় অবস্থিত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাগারে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়, এসময় গবেষণাগারে থাকা কঙ্কালটিকেও লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী অবস্থা বেগতিক দেখে পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।
এবিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা বাকরুদ্ধ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমাদের ওপর হামলা করে। আমাদের সব কক্ষে ভাঙচুর করেছে। কলেজে শিক্ষকদের গাড়িও ভাঙচুর রয়েছে। পুরো কলেজ এখন ধ্বংসস্তূপ।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি পুলিশকে কল দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের জানায়, তাদের উপযুক্ত ফোর্স না থাকায় পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আমি বারবার আর্মি পাঠানোর জন্য বলেছি, কিন্তু তাদের দিক থেকে কোনও রেসপন্স পাইনি। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা দেখে বলতে পারবো।’
এই দুই কলেজসহ সবমিলিয়ে ৩৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই সংঘর্ষে জড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, একটি কলেজের শিক্ষার্থী মারা গেছেন, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তাহলে এখানে কীভাবে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িয়ে পড়লো?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেসবুকে ইউনাইটেড কলেজেস অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে একটি গ্রুপে অ্যাকটিভ বিভিন্ন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। মূলত এই গ্রুপেই অভিজিতের মৃত্যু নিয়ে একাধিক পোস্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে। সেখান থেকেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
অভিজিত হাওলাদারের মৃত্যু এবং সংঘর্ষের সূত্রপাত
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে অভিজিৎ এর ব্যাচমেট সাওয়াদ জানান, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ১৭ নভেম্বর ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এই হাসপাতালে চিকিৎসা হবে না। পরে অন্য হাসপাতালে শিফট হতে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাতে গেলে তারা ডেকে আবার বলে চিকিৎসা করবে। তখন অভিজিতের রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ছিল ১ লাখ ৫ হাজার। রাতে তার শরীরে খিচুনি আসলে ডাক্তার জানান, সে নাকি নেশা করে, এজন্য এমন করছে! পরে তার হাত পা বাঁধা হয়। কিছুক্ষণ পরে আবার ছেড়েও দেওয়া হয়।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এরপর সব ঠিকঠাক ছিল। অভিজিৎ মোটামুটি সুস্থই ছিল। তার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছিল, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছিল। পরদিন সকাল ৮টার দিকে তাকে যখন আমরা দেখতে যাই, তখনও অভিজিৎ সুস্থ ছিল। তবে সে বলছিল, এই হাসপাতালে ভালো লাগছে না, তাকে অন্য জায়গায় শিফট করতে। এরপর আমরা সেই ব্যবস্থা নিতে যাই। তবে দুপুরের পর ডাক্তাররা জানান, তার নাকি হার্টবিট কম। তাকে শক দিয়ে হার্টবিট বাড়াতে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। এ জন্য ৫০ হাজার টাকাও জমা দিতে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
‘সেসময় অভিজিতের পরিবার জানায়, টাকার সমস্যা নেই আপনারা আমাদের ছেলেকে সুস্থ করে দেন। এরপর আমরা সারা দিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু ডাক্তার কাউকেই কিছুই বলেননি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে একজনকে ডেকে ভেতরে নিয়ে যায় এবং বলে অভিজিৎ আর নেই। এটা শোনার পর তো আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভালো ছেলে দেখলাম খাচ্ছে, কথা বলছে; এর মাঝে মৃত্যু’, বলছিলেন অভিজিতের বন্ধু সাওয়াদ।
অভিজিতের এই সহপাঠী আরও বলেন, ‘অভিজিতের মৃত্যুর কথা শুনে আমরা সব বন্ধুরা যখন কারণ জানতে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে আইসিইউতে ঢুকি, তখন ডাক্তার মোবাইল ক্যামেরা অন দেখে বলে আপনাদের সঙ্গে কোনও কথাই বলবো না। আপনারা বের হয়ে যান। এরপর আমরা বের হওয়ার পর তাদের বলি, আমরা শুধু দুজন কথা বলবো। তারা মেনে নিয়ে জানায়, দাঁড়ান, একটু পর দুজন এসে কথা বলবেন।’
‘তিন-চার ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছিল, তবে ডেথ সার্টিফিকেট তখনও পাইনি’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা যে বললো, দেখা করবে। এরপর আর কারো খবর নাই, সবাই উধাও। নিচে রিসিপশন, কাউন্টার, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ড বয়— কেউ নেই। এরপর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা আসেন।’
‘এক পর্যায়ে আমাদের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়, আমাদের যে বিল ছিল সেটা মওকুফ করবে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ হাজার টাকা দেবে তারা। একটা জীবনের মূল্য কি ১০ হাজার টাকা? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কোন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীতে ১ লাখ ৫ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়? তারা জানিয়েছে, অভিজিতের নাকি ফুসফুসে পানি জমে গিয়েছিল। তার ইন্টার্নাল ব্লিডিং হয়েছে। এতো কিছু যখন হয়েছে, তারা আমাদের এগুলো জানায়নি কেন?’
‘যে চিকিৎসা তারা দিতে পারবে না, শুধু টাকার লোভে কেন তারা আমার ভাইকে আটকে রেখে মেরে ফেলবে। তারা রিপোর্টের কোনও আপডেট ফ্যামিলিকে কেন জানায়নি? অবশ্যই এর মধ্যে ঘাপলা আছে। আর যদি তাদের কোনও ভুল না-ই থাকে, তাহলে তারা ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দিতে চাইলো?’
অভিজিতের আরেক সহপাঠী তন্ময় অভিযোগ করেন, ‘এক পর্যায়ে কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এই তিন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ঘটনাস্থলে ফোন করে ডেকে আনা হয়। তারা এসে আমাদের একপর্যায়ে মারধর করে। সেদিন আমাদের কলেজের ১০-১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম আমাদের সহপাঠীর বিচারের দাবি নিয়ে। উল্টো আমাদের ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে মারধর করে। পরে রাত ১০টার দিকে আমরা ন্যাশনাল হাসপাতাল করি এবং পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি।’
অভিজিতের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) অভিজিৎ রায় এর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অবরোধ করলে পুলিশ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেদিন তাদের আন্দোলন দমন করতে কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এদিন হামলাতেও তাদের প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়।
মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন জানান, ‘আমরা আমাদের ভাইয়ের হত্যার বিচারের দাবিতে মিছিল করেছি। পুলিশ আমাদের সহযোগিতা না করে উল্টো মারধর করেছে। তাদের সঙ্গে এই দুই কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও যোগ দেয়।’
তবে এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে কবি নজরুল কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদলের এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আবির নামে এক ছেলে এই এলাকায় একটা কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয়। সেই ছেলে মাঝেমধ্যে কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী বলে পরিচিত দেয়। কখনও আবার সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী বলেও পরিচয় দেয়। আসলে সে কোনও কলেজেরই শিক্ষার্থী না। ন্যাশনালের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই তরুণই ছেলেপেলে নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চাঁদাবাজিও করেছে। আমরা তার বিষয়ে ইতোমধ্যে পুলিশকে অবহিত করেছি। তার সঙ্গে ছাত্রদলের কোনও সম্পর্ক নেই। ডিএমআরসির সঙ্গে আমাদের যা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি।
এ দিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে হাসপাতালে হামলার বিষয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল হাসপাতালের চিকিৎসক রশিদুল হাসান বলেন, মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে একদল শিক্ষার্থী। এতে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রমে স্থবির হয়ে গেছে। হাসপাতালে অবস্থানরত রোগীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দায়িত্বরত যেসব ডাক্তার ছিলাম তারাও বেশ আতঙ্কে ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যদি সুনির্দিষ্ট কোনও দাবি-দাওয়া থাকে তাহলে সেটা আলোচনা মাধ্যমে সমাধান করা উচিত ছিল। এভাবে হাসপাতালে আক্রমণ করা একেবারেই অনুচিত।
আরও পড়ুন:
ন্যাশনাল মেডিক্যালে সহিংসতা: ২ সাংবাদিক আহত