Homeসাহিত্যক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা


২৪তম পর্ব

মৃতলোকগুলোর ছায়ার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে

‘নিস্তব্ধতার মধ্যদিয়ে একটি শব্দধ্বনি
বিকালের বসন্ত অন্ধকারে মিলিয়ে যায়
ভাবতেই পারিনি—আমরা আছি, আমাদের পরেও আছে…

আচ্ছা বলুন তো, লোকে কেন ঘরে দুয়ার রাখে
কামরার ভেতরেও কামরার মাপ-জোখের টানাহেঁচড়া কেন হয়
আর কেন হয় দিন প্রহরের মাপ।”
— জীবন নরহ (অসমিয়া ভাষার কবি)

ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের বলিরক্ত স্মৃতিতে মেখে প্রথমবার আগরতলা ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম। ফ্লাইটে গৌহাটি, সেখান থেকে ট্রেনে জলপাইগুড়ি। ফিরে আসার দু-দিন আগে আমি ও প্রবুব্ধ আগরতলাকে কেন্দ্র করে সন্নিহিত নানা জায়গা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। অনেকটা সময় আমরা কাটালাম বিখ্যাত নীর মহল-এ। আগরতলা থেকে ৫৩ কি.মি. দূরত্বের এই মহলটি রুদ্রসাগর লেকের মধ্যে বানানো হয়েছে। ১৯২১ সালে এটি বানানোর উদ্যোগ নেন মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর। মোঘল নির্মাণ শৈলীতে এই ‘জলমহল’ বানিয়েছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত নির্মাতা কোম্পানি মার্কিন টস বার্ন। ভারতে দুটি এমন জলপ্রাসাদ রয়েছে, সবচেয়ে বড় জলমধ্যস্থ প্রাসাদ এটি, অন্যটি রাজস্থানের ‘জলমহল’। একটা নৌকো নিয়ে আমরা রুদ্রসাগরের জল কেটে কেটে দুজনে জলমহলে যখন যাই তখন বিকালের নরম আলো জলের উপর তির্যক ভাবে পড়ছে, ফেরার সময় আলো আরো কমে গেছে। প্রবুব্ধ ফেরার পথে আমাকে ওর ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ বইটি দিল। ভেতরে লেখা ছিল— ‘গৌতম, হে আমার গত জন্মের বন্ধু’। আজ, প্রবুন্ধহীন পৃথিবীতে এই কথাগুলো জন্মান্তরে অবিশ্বাসী দুই বন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসার নরম আলো পড়ে আরো তীব্র হয়ে ওঠে, যন্ত্রণায় ও শূন্যতায়। পরদিন ফিরে আসা আমার, সকালে খবর পেলাম প্রবুব্ধর বাবা মারা গেছেন। আমি যখন শ্মশানে পৌঁছলাম তখন দাহ কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। দাউদাউ চিতাকাঠের উপর আগুন, শুদ্ধতার লেলিহান শিখা। এজন্ম পরজন্ম— এমন কোনো জন্মান্তরের কথায় আমার বিশ্বাস নেই। আগুনেই যা কিছু শারীরিক তা ভস্ম হয়ে যায়। কিন্তু রয়ে যায় স্মৃতি, রয়ে যায় পুত্র কন্যা বন্ধু শত্রু মিত্রের কাছে সঞ্চিত অমলিন সেই স্মৃতি। এই স্মৃতির ভেতর থেকে কখনো কখনো ছাইচাপা আগুনের মতো ফুলকি ওঠে, শূন্যতা ভেসে বেড়ায়— প্রকৃত প্রিয়জনেরা এই আগুনের ফুলকি দেখতে পায়।

আমার সেদিনই বিকালে ফ্লাইট। তাই শ্মশান থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হল। ফিরে আসার আগে প্রবুব্ধের হাতটা দুহাতে খুব জোড়ে আমার দুহাতে চেপে ধরলাম, অনেকক্ষণ, যে হাত দুটি কিছুক্ষণ আগে তার বাবার প্রাণহীন দেহটা ধুইয়ে দিয়েছে, চিতায় তুলেছে। আজ বাবাকে নিয়ে লেখা ওর একটা কবিতা মনে পড়ছে—

আমার পাপার্ত দুটি হাত
জানি, এই হাতে বজ্র বাঁধা কখনো সম্ভপর নয়
অনুতাপ, অস্থিরতা থেকে ত্রাণ চেয়ে তাই
তোমার পবিত্র অস্থি গঙ্গায় ভাসাই।

১৯০৮, জানুয়ারি, ত্রিপুরার ‘ভাষা’ সাহিত্য গোষ্ঠী আয়োজন করেছিল এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠানের। বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন হাবিবুল্লাহ সিরাজী, জাহানারা পারভিন, বিমল গুহ সহ অনেকে। ছিলেন উত্তরপূর্বের নানা ভাষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি। অসমিয়া ভাষার কবি জীবন নরহ আর আমি একই ঘরে ছিলাম সেবার। অসমিয়া ভাষার তথা উত্তরপূর্বের আমার প্রজন্মের প্রধান কবি জীবন। জীবন তাঁর ‘নির্বাচিত অসমিয়া কবিতা’ বইটি আমাকে দিলেন, অসমিয়া থেকে অনুবাদ করেছেন মানিক দাস, প্রচ্ছদ মন্দাক্রান্ত সেন। ফেরার পথে আগরতলা বিমানঘাঁটিতে আমি ও জীবন একসঙ্গে গেলাম, ‘ভাষা’ সম্পাদক দিলীপ দাশ গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রিপোর্টিং ও বিমান ছাড়ার মাঝের এক ঘণ্টা, আমি জীবনকে বললাম, ‘কবিতা শোনাও, তোমার।’ ও বলল, ‘তুমি বেছে দাও’। বইটির পাতা উলটে ১৬ পাতায় ‘নিম্নবর্গ’ কবিতাটি এগিয়ে দিলাম। ও পড়ল—

“ইতিহাস খুঁড়তেই মাটির তলা থেকে উচ্ছন্ন
হাজার হাজার গ্রাম নদীর জলে মিশে গেল
জল থেকে উঠে আসা কতগুলো কাল্পনিক মানুষ
হা করে তাকিয়ে থাকে
মৃতলোকগুলোর ছায়ার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা
ইতিহাসের নায়ক আর ইতিহাস রচয়িতার দিকে…”

গৌহাটি বিমানবন্দর শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। দুজনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে শহরের কেন্দ্রে এলাম। এরপর ও চলে গেল নিজের গ্রামে। এরপর আর মুখোমুখি দেখা হয়নি জীবনের সঙ্গে। মানুষেরও জীবন মনে হয় এমনই…। কত বন্ধু, স্বজন, আত্মীয়, মিত্র— হয়ত জীবনে দেখাই হয় না, তার, মানুষের।

চলবে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত